মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলায় নদীতে সব ধরনের মাছ ধরা, বিক্রি ও পরিবহন নিষিদ্ধ। কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত পদ্মা নদীর ৫৭ কিলোমিটার এলাকায় অবাধে মা ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা। শুধু রাজবাড়ী না পদ্মা নদীর পাবনার অংশেও নির্বিচারে শিকার হচ্ছে ইলিশ।

নিবন্ধিত জেলে ছাড়াও মৌসুমী জেলেরা ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে পদ্মায় নেমেছেন ইলিশ ধরতে। নদীর পাড়েই অস্থায়ী হাট বসিয়ে প্রকাশ্যে বিক্রি করা হচ্ছে এসব ইলিশ। দূর থেকে ক্রেতারা আসছেন সস্তায় ইলিশ কিনতে। এজন্য মৎস্য বিভাগের উদাসীনতাকে দুষছেন স্থানীয়রা।

তবে জেলেদের দাবি, নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি সহায়তা দেওয়ার কথা থাকলেও তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত জেলেরা। আবার যারা পাচ্ছেন তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ কারণে পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে মাছ শিকারে নেমেছেন তারা।

সরেজমিনে রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকা ও পাবনা জেলার অংশের পদ্মা নদীতে জেলেদের নৌকা নিয়ে মাছ শিকার করতে দেখা গেছে। রাজবাড়ী প্রান্তে প্রশাসন ও মৎস্য বিভাগের অভিযান থাকলেও পদ্মা নদীর পাবানার অংশে প্রশাসন কিংবা মৎস্য বিভাগের কোন অভিযান দেখা যায়নি। সেখানে নির্বিচারে ইলিশ শিকার করছে জেলেরা।পাবনার প্রান্তেও নদীর পাড়প বসছে ইলিশের অস্থায়ী হাট। সেখানেও ক্রেতারা আসছেন ইলিশ মাছ কিনতে।

আজ শনিবার (১১ অক্টোবর) সকাল ৭টার দিকে গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের চর বরাট ও কাউলজানি এলাকায় পদ্মা পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ইলিশের অস্থায়ী হাট বসেছে। জেলেরা নদী থেকে ইলিশ শিকার করে এনে এই অস্থায়ী হাটে বিক্রি করছেন। ইলিশের এই অস্থায়ী হাট কেন্দ্রীক সেখানে বিভিন্ন পান-সিগারেট ও খাবারের দোকানও বসেছে। দূর-দুরান্ত থেকে মাছের ব্যাপারি ও ক্রেতারা এসে সস্তায় ইলিশ কিনছেন। ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ জেলেরা ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি সাইজের ইলিশ ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা ও ছোট ইলিশ ৪০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন।

রাজবাড়ী থেকে পাবনার প্রান্তে মাছ কিনতে গেছেন দুলাল ফকির। তিনি ৫০ টাকা দিয়ে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে পাবনা গিয়ছেন। তিনি বলেন, অভিযানের সময় ইলিশের দাম কম। পদ্মা নদীর পাবনার অংশে এসময় ইলিশের হাট বসে। তাই রাজবাড়ী থেকে এসেছি ইলিশ কিনতে। দামও কম আছে। কেজি দশেক কিনে ফ্রিজে রেখে খাব। অভিযান শেষে ইলিশের দাম চড়া হবে।

রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের কাউলজানি এলাকায় বসেছে ইলিশের অস্থায়ী হাট। প্রতিবছরই অভিযানের মৌসুমে এখানে হাট বসে। সেখানে মাছ কিনতে গিয়েছেন রুবেল মোল্লা। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যে মাছের দাম ৩ হাজার টাকা কেজি সেই মাছ এখন জেলেরা অর্ধেক দামে বিক্রি করছেন। যে কারণে এখান থেকে সস্তায় মাছ কিনতে এসেছি।

কথা হয় জেলে আজিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, যে লোক জেলে না, যার ঘরে ৫০ মণ ধান আছে সেই লোক জেলে কার্ডের সরকারি চাল পায়। অথচ আমি একজন গরিব জেলে, কিন্তু আমি চাল পাই না। আমরা মতো অধিকাংশ প্রকৃত জেলেরাই এই চাল পাই না। তাই পেটের তাগিদে বাধ্য হয়েই জাল নিয়ে নদীতে নামতে হচ্ছে। কিন্তু এই মৌসুমে প্রকৃত জেলের থেকে মৌসুমি জেলের সংখ্যা বেশি থাকে।

আরেক জেলে রুহুল আমিন বলেন, আমি ২৫ কেজি চাল পেয়েছি। কিন্তু এই সামান্য চাল দিয়ে কয়দিন সংসার চলে? আর শুধু চাল দিয়ে ভাত রান্না করেতো খাওয়া যায় না। আনুসঙ্গিক অনেক বাজার-সদাই লাগে। তার ওপর আবার কিস্তির চাপ আছে। তাই বাধ্য হয়ে মাছ ধরতে হচ্ছে।

এদিকে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীনও দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, লঞ্চঘাট, চলন্ত ফেরি ও লঞ্চে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীদের ডালিতে করে ইলিশ বিক্রি করতে দেখা গেছে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিজ্ঞাপন দিয়ে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে।

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ীর পাংশা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত পদ্মা নদীর ৫৭ কিলোমিটার এলাকা মা ইলিশের অভয়াশ্রম। গত ৪ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর বিকেল ৩টা পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে রাজবাড়ীতে পদ্মা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন সহ মৎস্য বিভাগ মোট ৫২ টি অভিযান পরিচালনা করা হয়।এসময় ১১ টি মোবাইল কোর্ট করা হয়। অভিযানকালীন সময়ে ২ লাখ ৯৩ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য ৫৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া ৬৬ কেজি ইলিশ মাছ জব্দ করা হয়। জব্দকৃত জাল আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয় এবং জব্দকৃত ইলিশ মাদরাসা ও এতিমখানায় বিতরণ করে দেওয়া হয়।

এছাড়া গত এক সপ্তাহের অভিযানে ২৭টি মামলার ২৭ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং মোট ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অভিযানকালীন আটককৃত নৌকা নিলামে বিক্রি করে ৩৬ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। অভিযানে ৯ জনের নামে নিয়মিত মামলা দায়েরও হয়েছে।

জেলায় ইলিশ আহরণে সম্পৃক্ত ৫ হাজার ৪৯৭ জন জেলের মধ্যে ৪ হাজার ৮৮৪ জন জেলেকে ২৫ কেজি করে ভিজিএফ এর চাল বিতরণ করা হয়েছে। শুধু সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের ৬১৩ জন জেলে বাকি রয়েছে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুব উল হক বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় আমাদের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত রয়েছে।জেলা প্রশাসন,উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ সমন্বয় করে কাজ করছে। কোস্টগার্ড, নৌ পুলিশ, জেলা পুলিশ ও আনসার আমাদেরকে অভিযানে সহায়তা প্রদান করছে। সরকার কর্তৃক ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেটা বাস্তবায়নে আমরা মাঠে থাকব।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরকে