হেলপার সজীব

পরিবার ছেড়ে দূরে থাকার বয়স হওয়ার আগেই বাবার মৃত্যু হয় বরগুনা সদর উপজেলার পরীরখাল নামক এলাকার বাসিন্দা সজীবের। সংসারের হাল ধরতে মাত্র ১২ বছর বয়সেই বাসের হেলপার হিসেবে চাকরি নিতে হয় তাকে। তবে সকাল থেকে রাত প্রতিদিন বাসে ডিউটি শেষে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা পারিশ্রমিক মেলে সজীবের। আবার অনেক সময় বিভিন্ন কারণে বাস চলাচল বন্ধ থাকলে বেকার সময়ও পার করতে হয় তাকে। এ সময় পরিবারের কেউ অসুস্থ হলেও সহজে মেলে না কোনো সহযোগিতা।    

অপরদিকে বাসের হেলপার হিসেবে চাকরি করায় অধিকাংশ সময় রাতে বাসের মধ্যেই ঘুমাতে হয় সজীবকে। আর এ সময়ে সারা দিনে যাত্রীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা এবং খারাপ আচরণসহ অনেক সময় চড়থাপ্পড় খাওয়ার স্মৃতিও মনে পরে তার। প্রায় সময়ই কষ্ট এবং অসহায়ত্ব নিয়ে রাতে বাসের মধ্যে ঘুমাতে গিয়ে নীরবে কান্নাও করেন সজীব। 

বরগুনা-বেতাগী এবং বরিশাল রুটে চলা রাফি খান নামে একটি বাসে বর্তমানে হেলপার হিসেবে চাকরি করছেন সজীব। বোনের বিয়ে হওয়ায় মা অধিকাংশ সময়ই মেয়ের বাড়িতে থাকেন। 

হেলপার হিসেবে সজীবের বর্তমান অবস্থা জানতে সরেজমিনে বরগুনার টাউন হল বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা যায়, নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বাস ছাড়ার পূর্বে বাসে পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করে যাত্রীদের গাড়িতে ডেকে তোলেন তিনি। আবার গন্তব্য থেকে ফিরে এসে একইভাবে বাস পরিষ্কারসহ যদি কোথাও কোনো মেরামতের প্রয়োজন হয়, চালকের সঙ্গে থেকে তাও করতে হয় সজীবকে। 

দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর ধরে বাসের হেলপার হিসেবে কর্মরত সজীবের সুখ-দুঃখ এবং বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাবার মৃত্যু পর ১২ বছর বয়সে আমি বাসের হেলপার হিসেবে চাকরি শুরু করি। ওই সময়ে ভালো পারিশ্রমিক পেলেও বর্তমানে এই পেশায় দৈনিক ৩০০-৪০০ টাকা আয় হয়। এ টাকায় আমার নিজের খরচ চালানোই এখন কষ্ট হয়ে যায়। তবে যাদের আর্থিক অবস্থা একটু ভালো তারা ভালো মন্দ খেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মরিচ দিয়ে ভাত খাওয়ার অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। বাবার মৃত্যুর পর মা আমাকে ছেড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেনি, আর এ কারণেই কষ্ট হলেও আমি মাকে নিয়েই আছি। এছাড়া বিকল্প কোনো কাজ না জানায় কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে এই পেশায় থাকতে হচ্ছে আমাকে।

বাস মালিক সমিতি অথাবা বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন থেকে প্রয়োজনীয় কোনো সহায়তা মেলে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঈদ এবং কোরবানির সময় মালিক বা গাড়ির চালকদের থেকে মাঝে মধ্যে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা এবং একটা জামা অথবা পাঞ্জাবি দেওয়া হয়। এছাড়া আর কোথাও থেকে তেমন কেউ কিছুই দেয় না। কিছুদিন পূর্বে আমি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলম। মা আমাকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে পারেনি। বাসায় বসেই চিকিৎসা করতে হয়েছে। ৫০০ টাকার ওষুধ লাগলেও মাত্র ১০০ টাকার ওষুধ খেয়েছি।

শুধু সজীব নয়, বরগুনার প্রায় সকল বাসের হেলপারদেরই একই অবস্থা। বিকল্প কোনো কাজ না জানায় বাধ্য হয়ে কম পারিশ্রমিকেই হেলপারের চাকরি করতে হয় তাদের। 

তবে শ্রমিক সংগঠন থেকে শ্রমিকদের বিপদের সময় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হয় জানিয়ে জেলা সড়ক পরিবহন ও শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি নাসির উদ্দীন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনায় যে সব শ্রমিক বাসে চাকরি করে তাদের বর্তমান পারিশ্রমিকের অবস্থা খুবই খারাপ। সড়কে বিভিন্ন অবৈধ গাড়ি চলাচলের কারণে বাসের আয় কমে যাওয়ায় তারা ঠিকভাবে বেতনও পায় না। তবে কোনো শ্রমিক যদি বাস দুর্ঘটনার কবলে পরে আহত হয়, তাদেকে মালিক সমিতি এবং শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হয়। এছাড়াও বিআরটিএ থেকে তাদের নির্ধারিত সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। 

জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. সহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা গাড়ির হেলপার অথবা সুপারভাইজার আছেন তাদের দৈনিক রোজগার খুবই কম। এ কারণে যদি তাদের সন্তানদের লেখাপড়া, বিয়ে অথা কেউ যদি কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করতে পারবেন। পরবর্তীতে আবেদনের যথার্থতা মিললে অবশ্যই তাদেরকে সহায়তা প্রদানের চেষ্টা করা হয়।      

বিভিন্ন সময়ে বাসের হেলপাররা খারাপ আচরণ করেন- যাত্রীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাসের হেলপার সজীব বলেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা গাড়িতেই ডিউটি করি। এই সময়ে বিভিন্ন ধরনের যাত্রীরা গাড়িতে যাতায়াত করেন। তবে অনেক সময় বসার সিট নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। ওই সময় আমরা বিষয়টি সমাধান করতে গেলে একজনের পক্ষে আরেকজনের বিপক্ষে গেলেই তারা বলে আমরা খারাপ আচরণ করি। অনেক সময় বিনা কারণেও যাত্রীরা আমাদের চড়থাপ্পড় দেয়। একজনের পক্ষে সকলের মন রক্ষা করা তো অসম্ভব।

বরগুনা জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক গ্রুপের দপ্তর সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনা থেকে প্রতিদিন প্রায় ২৫টি গাড়ি চলাচল করে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এসব গাড়িতে চালক এবং হেলপাররা ডিউটি করেন। ট্রিপে ৫০ জন যাত্রী থাকলে তাদের সকলের মন মানসিকতা এক হয় না। কেউ জোর করে হাফ ভাড়া দিতে চায়, কেউ কম ভাড়া দিতে চায় এমন অনেক বিষয় নিয়ে মাঝে মধ্যে যাত্রীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা হয়। তবে আমরা যাত্রীদের কোনো অভিযোগ পেলে প্রায় সময়ই হেলপার বা সংশ্লিষ্ট যে কাউকে ডেকে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদেরকে বোঝানো হয় যাতে কেউ যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করেন। 

বরগুনায় এক সময় বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির অধীনে বিভিন্ন রুটে নিয়মিত প্রায় ৭০ থকে ৭২টি গাড়ি চলাচল করতো। ওই সময়ে বাসের চালক-হেলপাররা দৈনিক ৮০০-১০০০ টাকা অনেক সময়ের বেশিও পারিশ্রমিক পেত। তবে কী কারণে বর্তমানে বাসের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে এবং পারিশ্রমিকও কমেছে তা জানতে কথা হয় বিভিন্ন বাস মালিক এবং চালকদের সঙ্গে। তাদের অভিযোগ, সড়কে বিপুল পরিমাণ অটোরিকশা এবং সিএনজি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসের যাত্রী কমায় দিন দিন বাসের সংখ্যা কমে পারিশ্রমিকও কমেছে। 

রাফি খান পরিবহন নামে একটি বাসের চালক মো. মহসীন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাসের মধ্যে চালক, হেলপার এবং সুপারভাইজারসহ তিনজনকে থাকতে হয়। তবে সারাদিনের কাজের হিসেবে আমারা কেউ তেমন ভালো পারিশ্রমিক পাই না। প্রতিদিন তিনটার বেশি ট্রিপ হয় না, সবমিলিয়ে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আসে। কিন্তু এর মধ্যে তেল খরচই হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি ১ হাজার বা ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে মালিককে দিয়ে আমারা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং হেলপার ৩০০-৪০০ টাকার বেশি পায় না।      

প্রায় ২০ বছর ধরে বাসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সাজিদ পরিবহন নামে একটি বাসের মালিক এস আই মাসুম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সময় বরগুনার বিভিন্ন রুটে বাস মালিক সমিতির অধীনে প্রায় ৭২টি গাড়ি চলতো। ওই সময়ে শ্রমিক মালিক উভয় পক্ষেরই ভালো টাকা আয় হতো। কিন্তু বর্তমানে সড়কে বিভিন্ন অনিয়মের কারণে আমরা শ্রমিক এবং মালিক সবাই এখন দিশাহারা। দিন শেষে একটি বাস সড়কে চলার পর সব খরচ বাদে ৫০০-৭০০ টাকা দেওয়া হয় একজন বাস মালিককে। এই টাকা থেকে বাস স্টাফদের কী দেওয়া যায়, আর মালিকরাই বা কি নিতে পারে। দিনদিন সড়কে অবৈধ গাড়ি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাসের রুট কমেছে, যাত্রী কমেছে। আর এ কারণে এমনও হতে পারে বাসের ব্যবসা থেকে যে কোনো সময় মালিকরা সরে যাবে।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা বাস ও মিনিবাস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মো. ইকবাল হোসেন সোহাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি বাসের পেছনে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে বর্তমানে মালিকরা এক হাজার থেকে দুই হাজার টাকার বেশি পায় না। কিন্তু একই সড়কে দেড় লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা ব্যয়ে অটোরিকশা-সিএনজি যারা চালায় তারা একদিনে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা আয় করে। আর এ কারণেই বাসের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং শ্রমিকরাও তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না।

আরএআর