বিভাগীয় নগরী রংপুরের ব্যস্ততম এলাকা শাপলা চত্বর। বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে পরিচিত এই শাপলা চত্বরের ওপর দিয়ে প্রতিদিন জেলা ও আন্তঃজেলা রুটের শতশত বাস ও ট্রাক চলাচল করে। কখনো কখনো বাসের যাত্রী উঠানামা করতে গিয়ে ভাড়া নিয়ে ঘটে বাক-বিতণ্ডা। গত বুধবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে এমনি এক ঘটনা চোখে পড়ে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। ভাড়া কম দিতে চাওয়ায় এক যাত্রীর ওপর মেজাজ বিগড়ে যায় সুপারভাইজারের।

রংপুর থেকে বদরগঞ্জ ও পার্বতীপুর রুটে চলাচল করা তানি পরিবহনের সুপারভাইজার (কন্টাক্টর) জাহাঙ্গীর আলম। তার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন নজরুল ইসলাম নামে সত্তরোর্ধ্ব বয়সী এক যাত্রী। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরে আসতে মেইল বাসে ভাড়া গুনতে হয় ৮০ টাকা। কিন্তু নজরুল ইসলাম নির্ধারিত ১০ টাকা কম দিতে চাওয়ায় বাধে বিপত্তি। শেষ পর্যন্ত বয়স্ক এ যাত্রীর কাছ থেকে মানবিক কারণে ভাড়া কম নিলেও সুপারভাইজারের মন-মেজাজ চড়া ছিল।

মাত্র ১০ টাকার জন্য এমন রাগারাগি, পরে আবার কম নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, হামার (আমাদের) তো আগের মতো এ্যলা (এখন) কামাই (উপার্জন) নাই। এমন সবাই যদি পাঁচ-দশ টাকা করে কম দেয়, তালে বাসের তেল খরচ, মালিকের জমা আর হামার নিজের পরিশ্রমের টাকা পামো কেমন করি।‌

শুধু কী পারিশ্রমিকের জন্যই এমন আচরণ করতে হয়, এ প্রশ্নে খানিকটা চুপ থাকেন জাহাঙ্গীর আলম। এরপর মুচকি হেসে জানান, তিনি ৯৫ সাল থেকে যাত্রীদের সঙ্গে উঠাবসা করে আসছেন। কিছু কিছু যাত্রী আছে পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও ভাড়া কম দিতে চায়, বিভিন্ন অযুহাত দেখায়। কখনো কখনো হেলপার-কন্টাক্টরের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করে।

তিনি আর বলেন, হামরাও (আমরা) তো মানুষ। সোগসময় (সবসময়) মন মেজাজ তো এক থাকে না। সংসারের খরচ, কিস্তি, ছাওয়ার (ছেলে-মেয়ের) লেখাপড়ার টাকা সোগ (সব) কিছু এই বাসের কামাই (উপার্জন) দিয়্যা (দিয়ে) চলে। কোনো দিন ২০০-২৫০ টাকা পাই, কোনো কোনো দিন বেশিও হয়। ফির (আবার) এমনো দিন আছে খালি হাতে বাড়ি যাওয়া লাগে। মানসিক চাপে মাথা তখন ঠিক থাকে না।

জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার স্ত্রীর বড় বোনের স্বামী বাসচালক শফিকুল ইসলাম ক্যান্সার আক্রান্ত। দুটো কিডনি বিকল হয়ে গেছে। চিকিৎসা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পায়নি। শুধু টাকার অভাবে এখন ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছে না। 

তেতালিল্লশ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর আলম রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার মীরবাগ এলাকার আনোয়ার হোসেনের ছেলে। তিনি দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে পরিবহন সেক্টরে কাজ করছেন। তার শ্বশুর সোমন আলী ট্রাকচালক ছিলেন। চার দশক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন শয্যাশায়ী। শেষ পর্যন্ত অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়।

বংশপরম্পরায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ‘শ্রমিক পরিবার’

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় জাহাঙ্গীর জানান, তার শ্বশুর সোমন আলীর দুই স্ত্রী মনোয়ারা ও মনো বেগম। তাদের সংসারে সন্তান ছিল ১৩ জন। গর্ভাকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির অভাবে অকালেই ঝরে যায় ৪ সন্তান। বর্তমানে এক ছেলে ও আট মেয়ে রয়েছে। তাদের সকলেরই বিয়ে হয়েছে। এদের মধ্যে তিন মেয়ের জামাতা পরিবহন শ্রমিক। অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারণে ছেলে-মেয়েদের বেশিরভাগ হাইস্কুলের গণ্ডিই পেরোতে পারেনি। একই ধকল সামলাতে হচ্ছে জাহাঙ্গীর আলমকেও। তার চার মেয়ের পড়ালেখার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে।

খোঁজ নিয়ে কথা হয় সোমন আলীর পরিবারের সদস্যদের সাথে। তার মেয়ে শাহজাদী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামীও বাসচালক। আমার বাবাও চালক (ড্রাইভার) ছিলেন। আজ আমরা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। অর্থাভাবে আমার দুলাভাইয়ের চিকিৎসা হচ্ছে না। আমার বোনটাও অনেক দিন ধরে অসুস্থ। তারা যে একবেলা ভালো খাবার খাবে, সেটাও জোগার করা কষ্টসাধ্য।

অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি বলেন, এই কষ্টের দিনগুলোতে আমাদের পাশে কেউ নেই। শ্রমিক সংগঠনের নেতারা খোঁজ নেয়নি। আমার বাবার মতো দুলাভাইও চোখের সামনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

বংশপরম্পরায় সোমন আলী ড্রাইভারের আত্নীয়-স্বজনদের অনেকেই জড়িয়েছে পরিবহনজগতে। তাদের অনেকের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বাঁকে বাঁকে মিশে আছে সড়কে ছুটে বেড়ানোর গল্প। যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে মিশে গেছে ‘শ্রমিক পরিবার’ শব্দটি।

সম্প্রতি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সোমন আলীর ভাগনে জামাই আব্দুস ছালাম। যাকে সবাই ছালাম ড্রাইভার নামেই চেনেন। রংপুর নগরীর হাজীপাড়া চামড়াপট্টি এলাকার বাসিন্দা তিনি। তার মৃত্যুর পর দাফন কার্যসম্পাদন করতে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ১৫ হাজার টাকা সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি মিললেও এখন পর্যন্ত সেই টাকা দেওয়া হয়নি। কেউ আব্দুস ছালাম ড্রাইভারের পরিবারের খোঁজও নিতে আসেনি।

জানা গেছে, আব্দুস ছালাম ড্রাইভারের দুই স্ত্রীর সংসারে এক ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান রয়েছে। এদের সবাই বিবাহিত। ছেলে ও দুই মেয়ের জামাতা সবাই ট্রাকচালক। সোমন আলী ও আব্দুস ছালাম ড্রাইভারের পরিবারের মতো এমন অসংখ্য ‘পরিবারের স্টিয়ারিং’ যেন আটকে গেছে পরিবহন সেক্টরের জালে। দিন যায়, মাস যায়, এভাবে শেষ হয় বছরের পর বছর, কিন্তু এসব শ্রমিক পরিবারের ভাগ্যে নেই তেমন কোনো পরিবর্তন।

কেউ দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামেনি, অবাক শ্রমিকরা

শাপলা চত্বর থেকে কলেজ রোডের দিকে গেলে চোখে পড়বে পুরাতন ট্রাকস্ট্যান্ড। যা এখন কুড়িগ্রাম মেইল বাসস্ট্যান্ড নামে পরিচিত। সেখানে সরেজমিনে দেখা যায় পরিবহন শ্রমিকদের হাঁকডাক। কেউ যাত্রীদের হাত ধরে কেউ বা ইশারায় ডাক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন টিকেট কাউন্টারে। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে ৫০-৭০টি বাস রংপুর-কুড়িগ্রাম, বদরগঞ্জ-পার্বতীপুর ও গাইবান্ধা-মাঠেরহাট রুটে চলাচল করে থাকে।

বাসস্ট্যান্ড ঘুরে দেখা যায়, গাড়ি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন অনেকে। কেউ ব্যস্ত বাসের যাত্রীদের নিয়ে। আবার অনেকে অলস সময় কাটাচ্ছেন বাসের ভেতর শুয়ে। কেউ বা গল্পে আড্ডায় মেতে। তাদের মধ্যে কথা হয় বেশ কয়েকজন বাসচালক, হেলপার ও সুপারভাইজারের (কন্টাক্টর) সাথে।

পরিবহন শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, সংসার ও মজুরি নিয়ে বাস্তবতার গল্প শোনান তারা। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন পেশার মানুষ তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, চাকরি নিরাপত্তা ও বাস্তবতার নিরিখে সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করলেও পরিবহন শ্রমিক নেতাদের কেউই রাজপথে না নামায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস কেনার আগে ভাবতে হয়

বাসচালক মহুবার রহমান। বয়স ৫৩ বছর। চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে আছেন তিনি। এগারো বছর বয়সে সহকারী মিস্ত্রি হিসেবে এ পেশায় নাম লেখান। এরপর হেলপার থেকে সুপারভাইজার, পরবর্তীতে বাসের স্টিয়ারিং হাতে নেন। যাত্রীসেবায় নিজের জীবনের অর্ধেক সময় পার করা এই বাসচালকের এখনো হতাশায় দিন কাটে।

রংপুর থেকে বদরগঞ্জ-পার্বতীপুর রুটে চলাচল করা তানি এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের চালক তিনি। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, প্রতিমাসে তার আয় ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বর্তমান বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সংসারের খরচ নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। মহুবারের ভাষ্যমতে, সখ করে সপ্তাহে একদিন মাছ-মাংস ও দুধ-ডিম কিনে খেতে হলে আগে কয়েকবার তাকে ভাবতে হয়।

রংপুর মহানগরীর বড়বাড়ি দোলাপাড়া এলাকার আব্দুর রহমানের ছেলে মহুবার রহমান। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে নিজে ঠিকমতো পড়ালেখা করতে পারেননি। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন সন্তানদের বেলাতে না হয়, এজন্য দিনরাত কষ্ট করতে রাজি তিনি। তারপরও মাস শেষে তাকে ধারদেনা করে নয়তো এনজিওর ঋণে ভরসা করতে হয়।

মটর শ্রমিকদের নেই নির্দিষ্ট বেতন, কাজের সময়সীমা

মেঘনা পরিবহনের চালক জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে বলেন, আমি ৯৫ সাল থেকে এই জগতে আছি। শুরুতে হেলপার ছিলাম এখন ড্রাইভার হয়েছি। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ডিউটি করি। কিন্তু টাকা নিয়ে যে বাড়ি ফিরতে পারবো এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। সারাদিনের কাজের হিসেবে আমরা কেউ তেমন ভালো পারিশ্রমিক পাই না। এখন তিনটার বেশি ট্রিপ হয় না, সবমিলিয়ে মাত্র ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা আসে। কখনো পাঁচ হাজার হয়। কিন্তু এর মধ্যে তেল খরচই হয় ২ হাজার ৫০০ টাকা। বাকি ১ হাজার বা ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে মালিককে দিয়ে আমরা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং হেলপার ৩০০-৪০০ টাকার বেশি পাই না।

তিনি আরও বলেন, আমরা মালিকের চাকরি করি কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো বেতন-ভাতা নেই। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা যাত্রীসেবা দিয়ে আসছি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজের একটা সময়সীমা আছে, সর্বনিম্ন বেতন স্কেল আছে। আমাদের এসবের কিছুই নেই। সবাই শুধু স্বপ্ন দেখায় গল্প শোনায় বাস্তবে সব জিরো। করোনা মহামারি, লকডাউন, শাটডাউন, ধর্মঘট হলে আমাদের অবস্থা আরও করুণ হয়। এক কথায়, গাড়ির চাকার সঙ্গে আমাদের পেটের সম্পর্ক। চাকা ঘুরলে বউ-বাচ্চারা একটু ভালোমন্দ হলেও খেতে পারে।

রংপুর সিটি বাস টার্মিনালে গাড়ির চাকা মেরামতের জন্য ছুটে যাচ্ছিলেন এক শ্রমিক। কথা হয় তার সাথে। নাম প্রকাশে অনিহা জানিয়ে এই শ্রমিক জানান, দুই মাস ধরে বাসায় মাংস রান্না হয়নি। মাঝেমধ্যে পাঙ্গাস মাছ আর নিরামিষ তরকারি দিয়ে চলছে। কিন্তু তার বাচ্চারা নিরামিষ খেতে চায় না।

ঢাকা পোস্টকে এই শ্রমিক বলেন, আমার সখ আছে, সামর্থ্য নেই। মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা রোজগার হয়। এই টাকা থেকে ঘর-ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, ছোট বাচ্চার জন্য দুধ-ডিম কিনতে হয় তাকে। নিজে ঠিকমতো আয় রোজগার করতে পারি না। এ কারণে আমার বউ অন্যের বাড়িতে গৃহস্থালির কাজ করে। তারপরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসায় পিছিয়ে শ্রমিকদের সন্তানরা

নগরীর বাবুখাঁ এলাকার সুপারভাইজার খালেক (ছদ্মনাম)। বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবন যুদ্ধে হোঁচট খাওয়া এই মানুষটি বিকল্প কাজে মাঝেমধ্যে সড়ক ছেড়ে ছুটে বেড়ান জমি কেনাবেচার মাধ্যম (দালাল) হয়ে। তারপরও সংসারে স্বচ্ছতা আসেনি। সন্তানদের ঠিকমতো পড়ালেখা করাতে না পারার আক্ষেপ আছে তার।

ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমাদের ছেলেরা পড়ালেখা শিখে মানুষ হোক, এটা মালিকরা চায় না। তারা চায় আমাদের ছেলেরাও আমাদের মতো শ্রমিক হোক। আমরা তো নিজেরা পড়াশোনা করতে পারিনি। এ কারণে এই পেশায় এসেছি। কিন্তু এই পরিবহন জগতটা এমন, চাইলেই সন্তানদের পড়ালেখা করানো সম্ভব না। এজন্য টাকার প্রয়োজন, টাকা ছাড়া আমাদের ছেলে-মেয়েদের ভালো জায়গায় (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) পড়ালেখার সুযোগ হয় না।

খালেক বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েদের কোথায় পড়াব? শ্রমিকের সন্তানদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো স্কুল-কলেজ নেই। যাদের খুব অভাব, হাতের অবস্থা খারাপ, দিন আনে দিন খায় তারাতো ছেলেদের মাদরাসায় নয়তো এতিমখানায় পড়ালেখা করায়। অথচ আমাদের দেশে পুলিশদের সন্তানের জন্য পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেনাবাহিনীর সন্তানদের জন্য ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ রয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিজীবীদের অনেকের ছেলে মেয়ে কালেক্টর এর স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। বড় বড় ব্যবসায়ীরাও চেম্বার অফ কমার্স নামে স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। লায়ন্স, বিয়াম এমন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রংপুরে রয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো অসহায় গরিব দুঃস্থ শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য কোনো স্কুল-কলেজ নেই। আমাদের বাস মালিক ও শ্রমিক নেতারা আমাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও চিকিৎসা নিয়ে কখনো চিন্তা করে না। সরকারও আমাদেরকে কখনো সুদৃষ্টিতে দেখেনি।

সন্তানদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে বিশেষায়িত শ্রমিক হাসপাতাল থাকাটা আরও বেশি জরুরি বলে মনে করেন মোহাম্মদ নুরুন্নবী। এই শ্রমিক তানি এন্টারপ্রাইজ পরিবহনের সুপারভাইজার। ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি পরিবহন সেক্টরে আছেন।

নগরীর গণেশপুর এলাকার বাসিন্দা নুরুন্নবী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের যদি একটা শ্রমিক হাসপাতাল থাকতো অন্তত মৃত্যুর আগে চিকিৎসাসেবাটা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতো। শ্রমিক ইউনিয়নে‌ অনেক টাকা, কিন্তু নেতারা কখনো আমাদের নিয়ে মন থেকে ভাবেন না। তারা সবাই ভোটের রাজনীতিতে শ্রমিকদের নিয়ে খেলা করে। সরকার সড়ক পরিবহন আইন করেছে। সেটাও আমাদের কোনো কাজে লাগছে না। বরং আমাদের হয়রানি বেড়েছে। আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে কেউ ভাবে না।

দাবি আদায়ে ব্যর্থ শ্রমিকরা, অবস্থার পরিবর্তন জরুরি

শ্রমিক অধিকার আন্দোলন রংপুরের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সড়ক পরিবহন আইন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রণীত হলেও আইনের অপব্যবহারের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আইনে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা এবং কল্যাণ নিশ্চিত করার বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও মালিকপক্ষ তথা সরকারের স্বদিচ্ছার অভাবে সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, যে শ্রমিকদের শ্রমে ঘামে যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রয়েছে সেই শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরিসহ নানা ক্ষেত্রে মৌলিক ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমনকি কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার শিকার কিংবা মৃত্যুবরণ করলেও এর দায় অনেক সময়ই মালিকপক্ষ কিংবা সরকার নিতে চায় না। নীতিহীন ও সুবিধাবাদী শ্রমিক নেতৃত্বের কারণে দীর্ঘদিনেও পরিবহন শ্রমিকরা তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে সক্ষম হয়নি। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

মালিকরা দেন ‘মানবিক’ সহযোগিতা, শ্রমিক ইউনিয়নে সেটাও বন্ধ

রংপুর জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক ও জেলা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান বাবু ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে শ্রমিকদের আগের মতো সহযোগিতা করা, মাসিক অনুদান দেওয়া কিংবা ভাতা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন চিঠি দিয়ে এসব কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলায় আমরা কাউকে সমিতি থেকে সহযোগিতা করতে পারছি না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি বিভিন্নজনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এটা তো মানবিক ব্যাপার।  

বর্তমানে কাগজে কলমে রংপুর জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নে সদস্য সংখ্যা ৬ হাজার ৯৫৬ জন। তবে আসাদুজ্জামান বাবুর দাবি, সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করলে শ্রমিকদের এই সংখ্যা পাঁচ হাজারের নিচে নামবে।

জানা গেছে, শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে রংপুর জেলায় অন্তত তিন শতাধিক শ্রমিককে নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হতো। ঈদ-পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে ভাতা দেওয়া ছাড়াও শ্রমিকদের সন্তানদের পড়ালেখা ও বিয়ে অনুষ্ঠানে সহায়তা মিলতো। গুরুতর অসুস্থ শ্রমিকদের চিকিৎসায় এবং কারও মৃত্যু হলে ইউনিয়ন থেকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হতো।

চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে ছন্দপতন ঘটে শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রমে। নির্বাচিত কমিটির আওয়ামীপন্থী শ্রমিক নেতারা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। একই চিত্র রংপুর জেলা মটর মালিক সমিতিতেও।  

এদিকে রংপুর জেলা মটর মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম বারী রাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সমিতিতে ২০৭ সদস্য। জেলা ও আন্তঃজেলা মিলে তিন শতাধিকের বেশি গাড়ি রয়েছে। একেকটা গাড়িতে চালকসহ চারজন থাকে। তাদেরকে চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়। চেইনমাস্টাররা এসব দেখাশুনা করে। শ্রমিকদের বিভিন্নভাবে মানবিক সহযোগিতা করা হয়। তাদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বেশির ভাগ গাড়ির মালিকের এখন ধরাশয়ী অবস্থা। আগের মতো ব্যবসা নেই। সড়কে তো শুধু বাস-ট্রাক, মিনিবাস-মাইক্রোবাস চলাচল করে না, এখন যাত্রী পরিবহনে অবৈধ থ্রি-হুইলারের (সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকসা) ছড়াছড়ি। এ কারণেই বাসের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং শ্রমিকরাও তাদের ন্যায্য পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না।

যেসব রোগে ভোগেন পরিবহন শ্রমিকরা

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মো. মোস্তফা আলম বনি ঢাকা পোস্টকে জানান, পরিবহন শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি যে রোগগুলো হয়, তার মধ্যে প্রধান হলো পেশী ও হাড়ের সমস্যা_ যেমন অস্টিওআর্থ্রাইটিস এবং পেশীর দুর্বলতা। এছাড়া, দীর্ঘক্ষণ শারীরিক পরিশ্রমের কারণে ত্বকের রোগ (যেমন একজিমা), শ্বাসকষ্ট, এবং স্নায়বিক সমস্যার ঝুঁকিও থাকে।

শ্রমিকদের মেজাজ খিটখিটে হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, একটানা ও অতিরিক্ত কাজের চাপ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা এবং এর ফলে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক চাপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা, গরমে অস্বস্তি, পর্যাপ্ত বিশ্রাম না পাওয়ার ফলে তাদের ধৈর্য কমে যায়। এসব খিটখিটে মেজাজ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়াও আর্থিক ও সামাজিক চাপও তাদের বিরক্তি বাড়ায়।

জড়িয়ে পড়েন মাদকের সঙ্গেও

পরিবহন শ্রমিকদের হতাশার গল্পের আড়ালে আছে জীবন ধ্বংসের গল্পও। অনেক শ্রমিকই এ পেশায় এসে সঙ্গদোষে হয়েছেন মাদকাসক্ত। নিয়মিত মাদক সেবন আর সমাজিক অবনমনে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং রীতিনীতির অবক্ষয় হয়েছে অনেকের। এমনটাই জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শ্রমিক। 

একজন বয়স্ক বাসচালক নাম প্রকাশে অনিহা জানিয়ে বলেন, কেউ কেউ পরিবহন শ্রমিক পরিচয়ের আড়ালে মাদক কারবারিতে জড়িয়ে পড়ছে। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে মাদক পরিবহনের অপরাধে আটকও হয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশৃঙ্খলা, অপরাধপ্রবণতা এবং সামাজিক সম্পর্কের অবনতিতে শ্রমিকদের একটা অংশকে দেখা যায়। যাদের মধ্যে মাদকাসক্তি, নারী নির্যাতনের প্রবণতা বেশি। সরকারি উদ্যোগে শ্রমিকদের চিকিৎসা হয় না। যারা মাদক সেবন করে তাদের ডোপ টেস্ট, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে তেমন কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেই। 

রংপুর মহানগরীর স্নেহা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, জীবনের আলো মাদকাসক্তি ও মানসিক নিরাময় কেন্দ্র, স্বপ্ন মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রসহ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রমিকদের মধ্যে নিরাময় কেন্দ্র চিকিৎসা নেওয়া কিংবা মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা লোকজনের সংখ্যা খুবই কম। বেশির ভাগই চিকিৎসা নেন না। বরং সংসার জীবনে নেমে আসা অশান্তি আর স্ত্রী-সন্তানকে নির্যাতনের হতাশা থেকে কেউ কেউ মাদক সেবন করে অকালে ধুকে ধুকে মরছে।  

শ্রমিকের মধ্যে ‘সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ’ থাকাটা জরুরি

হাইওয়ে পুলিশের রংপুর রিজিয়ন পুলিশ সুপার আবু তোরাব মো. শামছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাঝে মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের নানান অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এর অন্যতম কারণ ভুল বোঝাবুঝি এবং অপরাধ স্বীকার করে না নেওয়ার প্রবণতা। শ্রমিকরা সবসময় মনে করে তারা যা বলবে তাই শুনতে হবে। কিন্তু আইন ভঙ্গ করলে তাদেরকে তা প্রথমে স্বীকার করতে হবে। আমরা মনে করি, এই অবস্থার সমাধান মিলবে শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতাবোধ জাগ্রত হলে। আর এজন্য আমরা চালক, হেলপারসহ পরিবহন সেক্টরের মালিক-শ্রমিকদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, পরিবহন শ্রমিকদের অনেক অভিযোগ। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোসহ দুর্ঘটনা, যাত্রী হয়রানি ও ভোগান্তি রোধে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। আইন প্রয়োগ করতে গেলে কখনো কখনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে। এজন্য শ্রমিকের মধ্যে ‘সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ’ থাকাটা বেশি জরুরি। শুধু পুলিশ চাইলেই সবকিছু স্বাভাবিক, সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে না।

শিক্ষা, সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ থেকে মালিক-শ্রমিক-পুলিশ-যাত্রী সাধারণসহ সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকতে হবে। শ্রমিকদের অনেকে মালিকের কাছ থেকে চুক্তিভিত্তিক ভাড়ায় গাড়ি চালায়। তখন বাস শ্রমিকদের উচিত গাড়ির আপডেট কাগজপত্র সঙ্গে রাখা, এটা মালিকেরও দায়িত্ব। বাসচালকের কাছে শুধু তার ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে হবে না। যে বাসটা সে (চালক) চালাবে সেটার কাজগপত্রসহ ফিটনেসও দেখার দায়িত্ব তার’ বলেন হাইওয়ে পুলিশ সুপার।

এমএএস