নারকেলের ছোবড়া থেকে সাফল্য, রোজী আহমেদের উদ্যোগে স্বাবলম্বী ৮০ নারী
বাগেরহাটের সদর উপজেলার বাসাবাটি এলাকায় নারীদের হাতে তৈরি অর্গানিক পণ্য এখন শুধু ঘরের সাজসজ্জা নয়, তাদের জীবিকা ও স্বপ্নের উৎস। নারকেলের ছোবড়া, কাঠ, কাপড় ও সুতা দিয়ে তাদের হাতে তৈরি পাখির বাসা, বিড়ালের খেলনা, দোলনা, জুতাসহ নানা ধরনের পণ্য বাজারে বিক্রি হয়। জার্মান, জাপান, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয় এগুলো। রোজী আহমেদের উদ্যোগে নারীবান্ধব এই কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন ৮০ জন নারী। এই শ্রম শুধু নারীদের আয়ের পথই খুলে দেয়নি, জুগিয়েছে তাদের আত্মবিশ্বাস।
সরেজমিনে দেখা যায়, রোজী আহমেদের ফ্যাক্টরিতে, বাড়ির উঠানে এবং পাশের দুটি একতলা ভবনে তৈরি হচ্ছে ৫০-৬০ প্রকারের অর্গানিক পণ্য। নারকেলের ছোবড়া ও আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে পাখির বাসা, দোলনা, নারকেলের জুতা। কাঠ, কাপড় ও সুতো দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিড়ালের খেলনা, চপিং বোর্ড, দোলনা, কাপড়ের ব্যাগ। প্রতিটি পণ্যে নারীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়া স্পষ্ট। প্রতিটি পণ্য নকশা অনুযায়ী সজ্জিত করা হয়, পরিশোধন করা হয়, এবং বিদেশে পাঠানোর জন্য নিখুঁতভাবে প্যাক করা হয়। জার্মান, জাপান, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এই উদ্যোগে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারীরা প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করছেন। প্রতিটি পণ্যে তাদের শ্রম ও সৃজনশীলতার ছোঁয়া রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
রোজী আহমেদের তিনতলা বসতবাড়ি ও পাশের দুটি একতলা ভবন মিলিয়ে গড়ে উঠেছে অর্গানিক প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরি। এখানে কমপক্ষে ৮০ জন নারীকর্মী কাজ করছেন। তারা প্রত্যেকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করছেন। নিরিবিলি পরিবেশে কাজ করার সুযোগ পেয়ে নারীরা অত্যন্ত খুশি।
বিজ্ঞাপন
করোনার সময় যখন সমস্ত মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখনই রোজী আহমেদ ফেসবুকে নিজের হাতে তৈরি নারকেলের মাজুনি বিক্রি শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর উদ্দিপন নামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আঁশের তৈরি পাখির বাসার তৈরির অর্ডার দেন। এরপর একের পর এক নতুন পণ্য তৈরি শুরু হয় এবং দেশের পাশাপাশি বিদেশে বিক্রি করা শুরু হয়।
রোজিনা বেগম নামে এক কর্মী বলেন, আমি এখানে কাজ করতে পেরে খুব খুশি। আগে ঘরে বসে থাকতাম, সংসারের কাজেই ব্যস্ত থাকতাম। কোনো উপার্জনের সুযোগ ছিল না। এখন এখানে কাজ করে আমি নিজেই আয় করি, পরিবারের খরচেও সহায়তা করতে পারছি। প্রতিদিন নতুন কিছু শিখি, প্রতিটি পণ্য তৈরি করার সময় আনন্দ পাই। পাখির বাসা, বিড়ালের খেলনা- প্রতিটি পণ্যে আমার হাতের ছোঁয়া আছে। এটি আমাদের জীবনের জন্য বড় পরিবর্তন এনেছে। আমি স্বপ্ন দেখি ভবিষ্যতে আরও অনেক নারী এমন উদ্যোগে যুক্ত হবে।
সাবিনা আক্তার নামে একজন বলেন, আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি। পুরুষদের দেখাশোনার প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন নতুন কিছু তৈরি করি, নতুন ডিজাইন চিন্তা করি। প্রতিটি পণ্য গ্রাহকের হাতে পৌঁছালে আমাদের আনন্দ দ্বিগুণ হয়। আত্মবিশ্বাসের এই অনুভূতি আমাদের জীবনে অনন্য। আমরা চাই আমাদের কাজ শুধু আয়ের নয়, দেশের নামও উজ্জ্বল করবে।
শ্রমিক নূরজাহান বেগম বলেন, করোনার সময় আমাদের অনেক সমস্যা হয়েছিল। সব মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনই রোজী আপা ফেসবুকে নিজের হাতে মাজুনি বিক্রি শুরু করেন। আমরা তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করি। এরপর আমাদের জীবনে আলো এসেছে। এখানে কাজ করতে পারা একদম স্বপ্নের মতো। প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার সুযোগ পেয়ে আমরা অনেক খুশি।
আর এক শ্রমিক মমতাজ বেগম বলেন, আমরা শুধু আয় করি না, নতুন নতুন পণ্য তৈরি করে নিজেদের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা বাড়ছে। প্রতিটি পণ্য আমাদের জন্য গর্বের। গ্রাহক যখন সেটি পায়, আমরা আনন্দিত হই। দেশের পাশাপাশি বিদেশেও আমাদের পণ্য যাচ্ছে, এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়াচ্ছে। আমরা চাই আমাদের কাজ বিশ্বের বাজারে পরিচিত হোক।
উদ্যোক্তা রোজী আহমেদ বলেন, করোনার সময় যখন সব মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখনই আমি ফেসবুকে একটি পেজ খুলে নিজ হাতে নারকেলের আঁশের মাজুনি বিক্রি শুরু করি। প্রথমে মনে হয়েছিল এটি কি চলবে? কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এরপর উদ্দিপন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এরপর একের পর এক নতুন পণ্য তৈরি করা শুরু হয়। দেশের পাশাপাশি জার্মান, জাপান, বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও অসহায় নারীদের জন্য নতুন কিছু করার পরিকল্পনা আছে।
তিনি আরও বলেন, আমার লক্ষ্য শুধু ব্যবসা নয়, নারীদের স্বাবলম্বী করা। আমরা চাই নারী শ্রমিকরা নিজেরাই জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হোক। প্রতিটি পণ্য শুধু বিক্রির জন্য নয়, নারীদের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতার প্রতীক।
বিসিক, বাগেরহাট উপ-ব্যবস্থাপক শরীফ সরদার বলেন, রোজী আহমেদের উদ্যোগ নারীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে। অর্গানিক পণ্য তৈরির মাধ্যমে দেশেও বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে। এটি অন্যান্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। রোজী আহমেদ ‘বাংলাদেশ ব্যাংক নারী উদ্যোক্তা সম্মাননা-২০২৪’ পেয়েছেন।
বাগেরহাটের এই উদ্যোগ শুধু নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে না, দেশেও বৈদেশিক মুদ্রা আনার পথ খুলছে। প্রতিটি নারী শ্রমিকের প্রতিদিনের শ্রম, সৃজনশীলতা ও অধ্যবসায় অর্গানিক পণ্যকে দেশের এবং বিদেশের বাজারে পরিচিতি দিয়েছে। রোজী আহমেদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ অসহায় নারীদের জীবনে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে।
নারীরা প্রতিদিন নতুন কিছু শিখছে, নতুন কিছু তৈরি করছে, এবং প্রতিটি পণ্যের সঙ্গে তাদের জীবনের গল্প ও স্বপ্ন মিশে আছে। এই উদ্যোগ অন্য নারীদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস এবং এটি প্রমাণ করছে, উদ্যোক্তা নারীর উদ্যোগে একদম ছোট উপকরণ থেকেও বিশাল অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব তৈরি করা সম্ভব।
শেখ আবু তালেব/আরকে