কাঁকন বাহিনী স্পিডবোট থেকেই গুলি করতে শুরু করে
মিঠু সরদার
পদ্মার চরে গোলাগুলির মুহূর্তে বর্ণনায় মিঠু সরদার বলেন, তখন ১১টা থেকে সোয়া ১১টা হবে। কাঁকন বাহিনী স্পিডবোটে করে আসে। স্পিডবোট থেকেই অতর্কিত গুলি করতে শুরু করে। ওরা গুলি করছে, আমরা গুলির ভয়ে শুয়ে আছি। তারা আটজন ছিল; কিছু না হলেও দুই ঘণ্টা গুলি করেছে। তারা দুইটি স্পিডবোটে এসেছিল। একটা লোক নামিয়ে চলে যায়। পরে আবার ফিরে আসে। আমাদের কাছে অস্ত্র নাই, মেশিন নাই, ঢাল নাই।
পদ্মা হবিরচরে গোলাগুলির ঘটনায় নিহত নাজমুলের বাড়ির পাশে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সকালে বাঘার নীচ খানপুর গ্রামে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন জলিল সরদারের ছেলে মিঠু সরদার। তিনি সোমবার (২৭ অক্টোবর) চরে গোলাগুলির সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন। স্থানীয় একটি সূত্র জানান, সোমবার সকালে পদ্মাচরে কাঁকন ও মণ্ডল গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে।
বিজ্ঞাপন
মিঠু বলেন, প্রথমে আমানের মাথায় গুলি লাগে। তাকে দেখে নাজমুল চিৎকার দিয়ে উঠে। এসময় আমানকে ধরতে গিয়ে নাজমুলকেও গুলি লাগে। তখন আমান বলে আমি আর বাঁচব না। তারপরে আর একটাও কথা বলেনি। আমাদের মধ্যে থেকে একজন কৌশলে এলাকায় ফোন করে। এলাকার লোকজন আশার আগেই কাঁকন বাহিনীর লোকজন সবাইকে ঘিরে ফেলে। তখন নামজুলও বলে উঠে মামা আমি মরে যাবে। আমি বাঁচব না।
তিনি আরও বলেন, যখন তারা গুলি চালাচ্ছিল তখন আমি শুয়ে পড়ি। তাদের আটজনের হাতে অস্ত্র ছিল। তিনটা লোককে আমি চিনেছি- চাকলাইয়ের ময়না, সাগর, ফিলিপ নগরের বুরবক। ওদের কাছে বড় বড় অস্ত্র। মোবাইল বের করতে পারিনি। কি করে ফোন করব। মাথার ওপর দিয়ে গুলি যাচ্ছে- জান বাঁচানই ফরজ কাজ। আমরা তো সাধারণ লোক। আমরা মাঠ দেখতে গিয়েছি। এই মাঠে দেড়শ বিঘা জমি আছে। জোর করি খড় কেনে নেয় কাঁকন বাহিনীর লোকজনেরা।
বিজ্ঞাপন
এর আগে সোমবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে পদ্মা নদীর হবিরচরে গোলাগুলির ঘটনায় আমান মন্ডল ও নাজমুল হোসেনের মৃত্যু হয়। পরের দিন মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) হবিরচর থেকে কুষ্টিয়ার লিটন নামের এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে নিহত নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আহাজারি করছেন তার স্ত্রী শারমিন বেগম। নিহত নাজমুলের দুই মেয়ে। একজনের নাম জান্নাতি (৩) অপরজনের নাম জামেলা খাতুন (২)। পাশে স্বজনরাও কান্না করছেন। মায়ের কান্না দেখে তারাও কান্না করছেন।
এসময় কান্না জড়িত কণ্ঠে শারমিন বেগম বলেন, আমার ছোট ছোট দুই মেয়ে। তাদের নিয়ে আমি এখন কোথায় যাব? তাদের কিভাবে বড় করব? তাদের কি খাওয়াব? ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে আমি অথৈ সাগরে পড়ে গেলাম। স্বজনরা বলছেন- গুলি লাগার পর থেকে একইভাবে কান্না করছেন শারমিন। নাজমুলের মৃত্যুর খবরে সারারাত কান্না করেছে সে। এখন ঠিকমতো কথা বলতে পারছেন না। শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করছেন।
নাজমুলের বাড়ির পাশে জুয়েলের মুদির দোকান। দোকানের পাশে বাঁশের মাচা পাতা রয়েছে। সেই মাচায় বসে রয়েছেন আহত-নিহতের স্বজনরা। সেমাবারের ঘটনায় তিনজন নিহত হলেও আহত হয়েছেন ছয় থেকে সাতজন। এছাড়া গুরুত্বর আহত আশরাফ মন্ডলের ছেলে রাকিব হোসেন (১৮), চান মন্ডলের ছেলে মুনতাজ মন্ডল (৩২) রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এসময় স্থানীয়রা জানান, ১৭ বছর আগে হবির চরের নীচ খানপুর এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ পরিবার বসবাস করত। নদী ভাঙনের কারণে তারা ভিটা ছাড়া হয়ে যায়। এরপর তারা বাঘার চর নীচ খানপুর এলাকায় বসবাস শুরু করে। তাদের দাবি-তাদের ওই চরে প্রায় ৯০০ থেকে ১ হাজার বিঘা জমি রয়েছে। সেগুলোর দলিলও তাদের বাবা-দাদার নামে রয়েছে। তারা সেখানে বিভিন্ন চাষাবাদ করে আসছিল। বিগত কয়েক বছর ধরে কাঁকন বাহিনীর লোকজনের কারণে জমির ফসল নিয়ে আসতে পারে না। ঘটনাস্থলে পুলিশের বড় বড় কর্মকর্তারা যাবেন। তাই তারা সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
জানা গেছে, সন্ধ্যায় নিহত আমান মন্ডল ও নাজমুল হোসেনের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এসময় আহাজারিতে ভেঙে পড়ে স্বজনরা। পরে তাদের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে নিহত আমান ও নাজমুলের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। আর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর পাওয়া লিটনের মরদেহ কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রয়েছে।
এ বিষয়ে বাঘা থানা পুলিশের ওসি তদন্ত সুপ্রভাত মন্ডল বলেন, এই ঘটনায় দৌলতপুর থানায় মামলা হয়েছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি। মামলার প্রস্তুতি প্রক্রয়াধীন।
এমএএস