জলাবদ্ধ জমিতে ফলছে সোনার ফসল, কৃষকের মুখে হাসি
জলাবদ্ধ ভূমিতে ভাসছে গাঢ় আর লালচে সবুজ লতাপাতা। পানির ওপর গোলাকারভাবে ভেসে থাকা পাতাগুলোকে দূর থেকে দেখতে অনেকটা শিঙাড়ার মতো দেখায়। আর এই পাতার নিচেই লুকিয়ে আছে ত্রিকোণাকৃতির এক ফল, যার নাম পানিফল। এখন এই জলজ ফলই জয়পুরহাটের চাষিদের কাছে ‘সোনার ফসল’ হয়ে উঠেছে। কচি অবস্থায় লাল আর পেকে গেলে কালো বর্ণ ধারণ করা এই ফল চাষ করে ভালো আয়ের মুখ দেখছেন তারা।
এ জেলার বিভিন্নস্থানে প্রায় ৩০ হেক্টর জমিতে এই মৌসুমে পানিফলের চাষ হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। সরেজমিনে জয়পুরহাট সদর উপজেলার গতনশহর এলাকায় দেখা যায়, নিচু জলাভূমিতে পানিফলের চাষ হয়েছে। চাষিরা পানিফল উত্তোলন করে সড়কের পাশে বসে ক্রেতাদের হাঁক-ডাক করে বিক্রি করছেন।
বিজ্ঞাপন
সেখানকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই ফলকে কেউ পানিফল, পানি শিঙাড়া, শিংড়া, শিংগাইর বা হিংগাইর বলে ডাকে। এই ফল চাষের পদ্ধতি বেশ সহজ। সাধারণত চৈত্র-বৈশাখ মাসে জলাশয়ে চারা রোপণ করা হয়। ছয় মাসের মধ্যেই অর্থাৎ আশ্বিন-কার্তিক মাস থেকে ফল সংগ্রহ শুরু হয়। এই চাষে সার ও কীটনাশক লাগে খুবই কম। প্রতি বিঘা জমিতে পানিফল চাষে খরচ হয় গড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। আর ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘা থেকে কৃষক বিক্রি করেন ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। এতে তাদের প্রায় ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা লাভ হয়। স্বল্প খরচে ভালো লাভ হওয়ায় এটি এখন এ এলাকায় লাভজনক মৌসুমি ফল হিসেবে জনপ্রিয় হচ্ছে। আর চাষিদের মুখে ফুটছে হাসি।
বিজ্ঞাপন
পানিফলচাষি মো. আজাদ বলেন, ‘এই জমিগুলোতে পানি বেশি থাকে। এ জন্য ধান আবাদ হয় না। তাই পানিফল আবাদ করি। এই ফল চাষে লাভ আছে। বিঘায় ৪০ থেকে ৫০ মণ হয়। এক হাজার থেকে এক হাজার ২’শ টাকা মণ বিক্রি করি। তাতে ধানের থেকে বেশি লাভ হয়।’
‘এ্যাসো (এসো) ভাই পানিফল, খালি ত্রিশ টাকা কেজি, এ্যাসো । টাটকা (সদ্য তোলা) ফল ভাই, এ্যাসো ভাই পানিফল, টাটকা ফল। এই যে ভিওত (জমি) থেকে তুলে দ্যাচি (দিচ্ছি), এ্যাসো।’ এমন ভাবে হাঁক-ডাক দিয়ে ক্রেতাদের ডাকছিলেন চাষি জিয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, পানিফলের আবাদ ভালো হয়। ১০ দিন পরপর তুলতে হয়। বিঘায় প্রতি টিপে ১০ মণের বেশি হয়। একমাস সুন্দর ফল হয়, পরে কমে যায়। ফলের ওপর নির্ভর হয়। ভালো ফলন হলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
সেলিম হোসেন নামে আরেক চাষি বলেন, ‘আমার সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি আছে। পানি থাকে এক কোমর করে, আমন ধান লাগান পারি না, এজন্য ফল লাগাচি। এই ফলে প্রচুর টাকা লাভ, লচ নাই। এখানে সর্বোচ্চ খরচ ১২ হাজার, কিন্তু এতো খরচ হবেই না, কমই খরচ হয়। আর বিঘায় ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। কারও জমিতে আমন ধান না হলে এক হাঁটু বা এক কোমড় পানি থাকলে তাদের জন্য ভালো। একদম ওয়া (রোপণ করা) বেটার, কোন লচ হবে না। এটি পাঁচবিবি হাটে মণ হিসেবে বিক্রি হয়। আর আমরা গিরস্তরা (চাষিরা) এখানে হাতে ২৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি করছি। আগে ৫০ টাকা কেজিতেও বিক্রি করিচি (করা হয়েছে)।’
পানিফল ক্রেতা রায়হান কবির জনি বলেন, আমি ইউনিয়ন পরিষদে চাকরি করি। জয়পুরহাট শহরে যাওয়ার পথে পানিফল কেনার জন্য গতনশহর এলাকায় দাঁড়িয়েছি। এই পানিফল বাচ্চা থেকে শুরু বড় সবাই পছন্দ করে। আমি ৩০ টাকায় এক কেজি পানিফল কিনেছি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এ.কে.এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, এ জেলায় আনুমানিক ৩০ হেক্টর জমিতে পানিফল চাষ হচ্ছে। এটা এক সময় সৌখিন পর্যায়ে ছিল, মানুষ ৫-১০ হেক্টর জমিতে চাষ করতো। কিন্তু এখন বাণিজ্যিকভাবে আবাদ হচ্ছে। এটি লাভজনক হওয়ায় কৃষক ভাইয়েরা খরচ করে উৎপাদন করছে এবং বিক্রি করছে।
তিনি বলেন, এই ফলটি পুষ্টিকর ফল, ছোট-বড় সবাই খেয়ে থাকে। এর মধ্যে বেশি কিছু খনিজ পদার্থ আছে, যেটা শরীরের জন্য উপকারী। আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষক ভাইদের পরামর্শ দিচ্ছি, যেন তারা বাণিজ্যিকভাবে এই পানিফল আবাদ করে লাভবান হতে পারে। সেই সঙ্গে আমরা বিক্রির ব্যাপারে সহযোগিতা করছি।
আরকে