জন্ম থেকে রিকেটস রোগে আক্রান্ত ফজলে রাব্বি ইমন। রোগের কারণে খুবই সামন্য ভার কিম্বা আঘাতে ভেঙেছে বুকের, হাতের ও পায়ের হাড়। চলাফেরা করেন হুইলচেয়ারে। বসেই সৃষ্টি করেন নান্দনিক সব শিল্পকর্ম। রোগের অদৃশ্য যন্ত্রণা ভুলে থাকতে চলে বিরামহীন শিল্পকর্ম। ইমনের বাড়ি রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বথুয়া গ্রামে।

পরিবার জানায়, ছোটবেলা থেকে রিকেটস নামক ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত রোগে আক্রান্ত ইমন। এই রোগ ইমনের নিত্যসঙ্গী। এই রোগের কারণে তার শরীরের হাড় ৩৭ বছর বয়সেও শক্ত হয়নি। এখনও শিশুদের মতো নরম। তাই হাঁটতে পারেন না। চলাফেরার জন্য হুইল চেয়ারই সম্বল। শুধু তাই নয়, খেতে গেলে দাঁত ভেঙে যায়। অনেক দাত মুখ থেকে খুলে পড়েও গেছে। দুই হাতে অসংখ্য জায়গায় ভাঙতে ভাঙতে প্রায় অচল।

ক্যালসিয়াম শূন্যতায় ২০১০ সালের শেষে দিকে পরোপুরি অচল হয়ে পড়েন ইমন। টানা পনের বছর শয্যাশায়ী। সম্প্রতি ক্যালসিয়াম-ঘাটতি খানিকটা পূরণ হওয়ায় দুই হাতে এসেছে শক্তি। হয়েছে কিছুটা সচল। এখনও উঠে দাঁড়াতে না পাড়লেও জ্বলে উঠেছেন সৃষ্টির আনন্দে। নিজ হাতে শিল্পকর্ম তৈরি করে যন্ত্রণাকে জয় করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন।

ফজলে রাব্বি ইমন বলেন, অসুস্থ্যতার মধ্যে দিয়ে আমার জীবন কেটেছে। ঢাকার পিজি ও শিশু হাসপাতালে আমার শৈশব কেটেছে। সেখানে চিকিৎসা ও চিকিৎসকের পেছনে দৌড়াদৌড়িতে সময় কেটেছে। যতদিন যাবে, আমার শরীরের হাড়গুলো ক্ষয় হয়ে যাবে। এখন যত বয়স যাচ্ছে সমস্যাগুলো আমাকে ঘায়েল করছে। এখন আমার বুকের হাড়গুলো খাচ্ছে। দাতগুলো পড়ে গিয়েছে রোগের কারণে। হাত-পাগুলো অনেক বেকে গেছে।

গত ৩ নভেম্বর দুপুরে রাব্বির বাড়িতে গিয়ে গেখা গেছে, ধান দিয়েই তৈরি করেছেন ধানের গোলা। এ ছাড়া, পালকি, গরুর গাড়ি, রিকশা, সিডনি অপেরা হাউজ। তার নান্দনিক শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে বটের ঝুরি, ধান, ডিমের খোসা, নারকেলের খোল, সুপারিগাছের ডাল, মোম, গমের নাড়া-আশপাশে যা পান, তাই ব্যবহার করেন। এই সাধারণ জিনিসগুলোই তার কল্পনার জগতের রঙতুলি। প্রতিটি শোপিসে তিনি গেঁথে দেন তার স্বপ্ন, ভালোবাসা। এটি তার পেশা নয়, অস্তিত্বের প্রকাশ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ।

তিনি আরও বলেন, ‘শিল্পকর্ম আমি তৈরি করি। শিল্পের প্রতি আমার ভালোবাসা আছে। আমার যে দুঃখ-কষ্ট, আমার যে যন্ত্রণাটা আছে, এটা যেন কম উপলব্ধি করতে পারি। যদিওবা স্রষ্ঠা এটা (অসুখ) আমাকে দিয়েছেন। তিনিই এটা নিয়ন্ত্রণ করবেন। তবুও এটার যে যন্ত্রনা আছে, এই অসুখটার যে যন্ত্রনা, এটা ভুলে থাকার জন্য আমি শিল্পকর্মের প্রতি অনেক সময় ব্যয় করি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র এতো বড় পর্দশনী বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছে কিনা, আমার জানা নেই। তবে আমি করেছি।’

রাব্বির পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধশতাধিক শোপিস নিয়ে সাত দিনের প্রদর্শনী করেছিলেন ফজলে রাব্বি। শিল্পকর্ম বিক্রির সব অর্থ তিনি দান করেছিলেন চারজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর মাঝে। ছোটবেলায় রাব্বিকে থাইল্যান্ডে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু টাকার অভাবে সম্ভব হয়নি। সে সময় যখন অন্য শিশুরা মাঠে দৌড়াতো, রাব্বি তখন শুধুই দেখতেন। এমন অবস্থায় তার মামি একদিন হাতে তুলে দেন শিল্পের উপকরণ। এরপর ভাঙা হাড়ের শরীরেই গড়ে উঠল সৃষ্টির অদম্য ইচ্ছা।

এইচএসসি পাস করে রাজশাহীর সরদহ সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন রাব্বি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে স্নাতক শেষ করতে পারেননি। তবে তার স্বপ্ন আর সংগ্রাম থেমে নেই। তিনি চান একটি চাকরি কিংবা প্রতিষ্ঠিত জায়গা। যেখানে রঙ দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে, সৃষ্টি দিয়ে ছড়িয়ে দিতে পারবেন তার আইডিয়া। সংসার জীবনে ইমনের ‍দুটি শিশু সন্তান রয়েছে।

ফজলে রাব্বির বাবা আয়ুব আলী বলেন, ‘ওর শরীর যদি ভালো থাকে তাহলে শিল্পকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে। এখন যদি ওর শরীর না চলে বা যদি না থাকে তাহলে কি হবে। ওর চিকিৎসার জন্য আমার সম্পত্তি বিক্রি করেছি। ও যেহেতু ভালো কাজ করে, পাশে কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ালে শিল্পকর্ম চালিয়ে যেতে পারবে। যে টাকা পাবে সেই টাকায় তার চিকিৎসা চলবে।’

বিষয়টি নিয়ে চারঘাট উপজেলা অ্যাসিল্যান্ড রাতুল করিমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জানা ছিল না, জানা হলো। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছুটি থেকে আসলে তাকে বিষয়টি জানানো হবে।’

শাহিনুল আশিক/এএমকে