বৃষ্টির দিনে নিচু এলাকায় নৌকার গুরুত্ব অনেকাংশেই বেড়ে যায়। এ কারণে বর্ষা শুরুর আগেই নৌকা বানানোর ধুম পড়ে। শুধু বর্ষা কেন্দ্রিক নয়, সারা বছরই নৌকা বানান শরীয়তপুর সদরের রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর গ্রামের লোকেরা। আদি আমল থেকেই নৌকা বানিয়ে আসছেন এই গ্রামের মানুষ।

কালের বিবর্তনে অনেকেই এই পেশা বা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। তবে নামটি রয়ে গেছে। আর যারা এখনও আছেন, তাদের নাম ডাকও কম নয়। শরীয়তপুর সদরের এই গ্রামটির ৩০টি পরিবার এখনও নিয়মিত তৈরি করছে নৌকা। নৌকা তৈরি করা হয় বলে এই গ্রামটি ‘নৌকা গ্রাম’ নামে পরিচিত।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিচু অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল শরীয়তপুর। বর্ষার দিনে বিলের পর বিল শুধু পানি থাকত। তখন বছরের ছয় মাস পানির নিচে থাকত এই অঞ্চলে বিভিন্ন এলাকা। সেসময় মানুষের চলাচলের জন্য ব্যবহার হতো নৌকা। আর জেলায় ব্যবহৃত নৌকা বেশিরভাগই রুদ্রকরের এই গ্রাম থেকে কিনে নিয়ে যেতেন ক্রেতারা। এখানে নৌকা বানানো হয় বলে তখন থেকেই এলাকাটি ‘নৌকা গ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, রুদ্রকর ইউনিয়নের চন্দনকর এলাকায় নৌকা তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। ঘরের পাশেই খোলা বড় জায়গায় নৌকা বানানোর কাঠ রাখা। সেখানে কাজ করছেন কয়েকজন নৌকা বানানোর শ্রমিকরা। ছোট থেকে বড় সব বয়সী মানুষকেই নৌকা বানানোর কাজ করতে দেখা গেল। কারও হাঁপ ছাড়ার উপায় নেই। তাদের কেউ কাঠ কাটছেন, কেউ নৌকায় পেরেক মারছেন। নৌকার ডাইসের মাধ্যমেই কাঠ কেটে নৌকার পাটাতন বানাচ্ছেন কেউ। কেউবা কাঠ কাটার পর তা সমান করছেন ডাইসে বসাতে।

মিস্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটি ছোট নৌকা বানাতে দুই দিন সময় লাগে। আর বড় হলে তিন দিনের প্রয়োজন হয়। আগে গাছের কাঠের দাম কম হওয়ায় নৌকা বানাতে তেমন খরচ পড়ত না। বিভিন্ন মালামাল কিনে ছোট নৌকা বানাতে এখন ছয় থেকে আট হাজার টাকা গুনতে হয়। এ কারণে ক্রেতারা কিছুটা হিমসিম খাচ্ছেন। সবকিছুরই দাম এখন বেশি। এবছর ছোট আর মাঝারি সাইজের নৌকার বেশি চাহিদা। বড় নৌকা বানাতে যে খরচ, তার থেকে কিছুটা কম খরচ হয় মাঝারি সাইজের নৌকা বানাতে।

নৌকা কিনতে আসা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এই গ্রামেই নৌকা বানানোর কাজ করে যাচ্ছে কিছু পরিবার। তাদের মাধ্যমেই এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে নৌকা তৈরি করে নিয়ে যাচ্ছেন ক্রেতা বা নৌকা বিক্রেতারা। আগে তিন থেকে চার হাজার টাকা দিয়ে বড় একটি নৌকা পাওয়া যেত। এখন সেই নৌকা কিনতে গুনতে হচ্ছে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা, তাও খাজনা ও ভাড়া ছাড়া। এতে নৌকা কিনে ব্যবহার করা গেলেও কিনে বিক্রি করাটা অনেক সমস্যার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

নৌকা মিস্ত্রী সঞ্জয় মন্ডল বলেন, বাবার সঙ্গে হাত ধরে কাঠের কাজ শিখেছি। আর অন্য কোনো কাজ করতে পারি না। এই নৌকার চাহিদা বছরে তিন থেকে চার মাস থাকে। এটির চাহিদা শেষের পর গ্রামে গিয়ে গিয়ে কাঠের কাজ করি। কিন্তু করোনা আসার পর কাজ অনেকটা নেই বললেই চলে। কষ্ট করে নৌকা বানিয়ে সংসার চালাতে হয়।

আরেক মিস্ত্রী ফুর্তি মৃধা বলেন, বাবা দাদারা এই কাজ করতেন। তাদের কাছ থেকে শিখেছি। একটি নৌকা বানাতে সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। আগে একটি নৌকা বিক্রি করলে দুই হাজার টাকা লাভ হতো। আর এখন একটি নৌকা বিক্রি করলে হাজিরার টাকাটাও ওঠাতে অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তারপরও কষ্ট করে বাপ দাদাদের কাজটি ধরে রেখেছি।

হৃদয় বৈরাগী নামের আরেক মিস্ত্রী বলেন, কাঠের দাম বেড়েছে, লোহার দাম বেড়েছে। গতবছর যেই লোহা কিনেছি ৬০ থেকে ৭০ টাকা দিয়ে, এবার তার দাম বেড়ে হয়েছে ১২০ থেকে ১৩০ টাকা হয়েছে। এতে সবকিছুর সঙ্গে নৌকারও দাম বেড়েছে।

নৌকা কিনতে আসা আনোয়ার হোসেন বলেন, নৌকা কিনতে এসে পড়েছি বিপাকে। কারণ জানতে চাইলে বলেন, নৌকার গায়ে আগুন। পানিবন্দি হয়ে থাকতে হবে যদি নৌকা না কিনি। তার থেকে বড় কথা নৌকা না নিলে বর্ষায় গরু ছাগল না খেয়ে মরবে। বর্ষায় পুরো এলাকা পানির নিচে চলে যায়। মাঠে পানি থাকায় ঘাস পাওয়া মুসকিল হয়ে যায়। নৌকা থাকলে কচুরিপানা কেটে খাওয়াতে পারব।

ক্রেতা হারুন বেপারী বলেন, নৌকা গ্রামের অনেক নাম ডাক। এখানের নৌকা যায় না, এমন কোনো এলাকা নেই। এই অঞ্চলে বর্ষার দিনে নৌকা ছাড়া চলাচল করা অনেক কষ্টকর। বেশিরভাগ এলাকায় বর্ষার প্রধান বাহন হয়ে যায় এই নৌকা। এবার নৌকার দাম অনেক বেড়ে গেছে। এতে করে অনেকেই নৌকা কিনতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে এখানকার নৌকাগুলো টেকসই ও বেশি দিন ব্যবহার করা যায়।

রুদ্রকর ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মজিবর রহমান খোকন বলেন, চন্দনকর এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ চার মাস নৌকা বানায়। বছরের বাকি সময় তারা অন্য কাজ করে। তারা বাহারি ডিজাইনে নৌকা বানান। তাদের নৌকা জেলার বিখ্যাত নৌকা।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এসএসএইচ