‘আমার ভাইরে যারা পুড়াইয়া মারছে তাদের বিচার চাই’
‘আমরা ভাইরে যারা আগুনে পুড়াইয়া মারছে, ওই খুনিদের বিচার চাই। আমার ভাই আর নাই, কী কারণে আমার ভাইরে পুড়ে মারছে। ওদের ধইরা আনেন। আমি জিগাই কেরে তারা আমার ভাইরে পুড়াইছে। আপনেরা খুনীদের ধরে বিচার করোইন।”— মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) বিকালে ফুলবাড়িয়া উপজেলার কৈয়ারচালা গ্রামে নিহত বাসচালক জুলহাস মিয়ার বাড়ির উঠানে এভাবেই আহাজারি করে বিচার দাবি করেন বোন মোছা. ময়না আক্তার ।
এ সময় পরিবারের আহাজারিতে অশ্রসজল হয়ে উঠে স্বজন ও প্রতিবেশিরাও।
বিজ্ঞাপন
গত সোমবার গভীর রাতে উপজেলার ভালুকজান এলাকার একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ৩ দুর্বৃত্ত মাস্ক পরে পেট্রোল ঢেলে বাসে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যায়। এতে বাসটিতে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান চালক জুলহাস মিয়া। তিনি স্থানীয় কৈয়ারচালা গ্রামের মো. সাজু মিয়ার ছেলে।
চোখের পানি মুছতে মুছতে জুলহাসের মা সাজেদা বেগম বলেন, “আমার ছেলে বাস চালায়, তারে আগুনে পুড়াইয়া মারছে। ছেলেটা আমার সপ্তাহে, ১৫ দিনে একদিন বাড়িতে আসত। তার অনেক ঋণ, সপ্তাহে দশ হাজার টাকা করে কিস্তি দিতে হয়। এছাড়া আরও তিন লাখ টাকা ধার ছিল। কিন্তু কষ্ট করেও হাসিমুখে সংসার চালাত। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করতাম। তাই সে বলতো ‘মা, তুমি আর কাজ করো না, আমি এখনও বেঁচে আছি। আজ আমার ছেলে কই গেল। আমি খুনিদের বিচার চাই।’”
বিজ্ঞাপন
মাত্র এক বছর আগে জাকিয়া আক্তারকে বিয়ে করেছিল নিহত জুলহাস। এর মধ্যেই আগুনে অঙ্গার স্বামী দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি।
বাকরুদ্ধ জাকিয়া বলেন, “এক বছর হলো আমরা সংসার শুরু করেছি। এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচব? যারা আমার স্বামীরে মারছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।”
স্থানীয়রা জানান, পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন জুলহাস মিয়া। মায়ের কষ্ট কমানোর জন্যই মানুষের বাড়িতে কাজ করতে বারণ করেছিলেন তিনি। একটি ঘর তুলেছিলেন ঋণের টাকায়, সংসারের সুখের স্বপ্ন বুনেছিলেন। কিন্তু আগুন সন্ত্রাসীদের আগুনে একটি সংসার, একটি ভবিষ্যৎ, এক মায়ের স্বপ্ন সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এসব তথ্য জানিয়ে কৈয়ারচালা গ্রামের রফিকুল ইসলাম বলেন, আগুন সন্ত্রাসীদের এমন নির্মমতায় ঘৃণা ও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে মানুষ। নিরাপরাধ জুলহাসের মৃত্যু হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। কিন্তু আমি জানতে চাই- একজন পরিশ্রমী চালকের প্রাণ কেড়ে নিল কেমন রাজনীতি।
আগুনের ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছেন বাসযাত্রী শাহিদ ইসলাম বাদশা (২০) এবং তার মা মোছা. শারমিন সুলতানা রুমকি (৪৫)। ঢাকা থেকে ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে তারা ভোরে বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বাসে অবস্থান করছিলেন। বাসটিতে দুর্বৃত্তরা হঠাৎ আগুন ধরিয়ে দিলে বাসের গ্লাস ভেঙে তারা নিচে নেমে আসেন।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার (এসপি) কাজী আখতার উল আলম জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নাশকতার উদ্দেশ্যে এই ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনাস্থলে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নাশকতাকারীদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি দ্রুত এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, গভীর রাতে পেট্রোল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের সামনের অংশে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় ৩ ব্যক্তি। এতে মুহূর্তেই পুরো বাসে আগুন ছড়িয়ে পড়লে দগ্ধ হয়ে মারা যান ঘুমন্ত বাসচালক জুলহাস।
ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রোকনুজ্জামান জানান, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আলম এশিয়া পরিবহনের বাসটি রাত ২টা ৪৫ মিনিটে ফুলবাড়িয়ায় পৌঁছায়। বাসটি তেল নেওয়ার জন্য একটি পেট্রোল পাম্পের সামনে থামানো হয়। যাত্রীরা সবাই নেমে গেলেও চালক জুলহাস মিয়া বাসের সিটে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ৩ দুর্বৃত্ত এসে হঠাৎ করে বাসে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই আগুন পুরো বাসে ছড়িয়ে পড়ে, বের হওয়ার সুযোগ পাননি জুলহাস। ঘটনাটি একটি পরিকল্পিত অগ্নিসংযোগের অংশ।
প্রসঙ্গত, আগামী ১৩ নভেম্বর সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগের লকডাউন কর্মসূচিকে ঘিরে এমন নাশকতার ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ফুলবাড়িয়া উপজেলায়।
মো: আমান উল্লাহ আকন্দ/এমটিআই