বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসনে গণসংযোগ ও উঠোন বৈঠকে তৎপর জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী ও বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। এ আসনে অনেক আগেই প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। এদিকে বিএনপি ফরিদপুরের চারটি আসনের তিনটিতে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করলেও ফরিদপুর-১ আসনে প্রার্থী স্থগিত রেখেছে।

এ দুটি বড় দল ছাড়াও পাশাপাশি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। প্রার্থী ঘোষণা না করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) একাধিক নেতা দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন। এদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ঠিক করা থাকলেও দলটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সে দিকে তাকিয়ে আছেন স্থানীয় নেতারা।

ফরিদপুর–১ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছাড়া উল্লেখযোগ্য দলগুলোর প্রার্থিতা নিয়ে ধোঁয়াশা যেন এখনো কাটছে না। বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রার্থী ঘোষণা না করা এবং জাতীয় পার্টির নির্বাচন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় এ আসনে নির্বাচনী প্রচারণায় এখনো গতি আসেনি।

দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির কোন্দল

এ আসনটিতে বরাবরই ছিল আওয়ামী লীগের দাপট বেশি। নির্বাচনী ইতিহাসও তাই বলে। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ফরিদপুর-১ আসনে জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী জয় লাভ করতে পারেনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের দাপটের কারণে। তবে ২০০৫ সালের উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহ মো. আবু জাফর নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত এই আসনে আবার ঘটে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।

এবার ত্রয়োদশ নির্বাচনে এখন পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন নিয়ে বিএনপির কোন্দল রয়েছে। ফরিদপুরের চারটি আসনের মধ্যে তিনটি আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হলেও ফরিদপুর-১ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। এ আসনে দলীয় কোন্দল চোখে পড়ার মতো। তবে দলীয় কোন্দলের মধ্যেই চলছে বিএনপির দুই পক্ষের মিছিল-সমাবেশ ও হামলার ঘটনা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলীয় মনোনয়নের জন্য সক্রিয় কেন্দ্রীয় কৃষকদলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম, বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুদ্দীন মিয়া ওরফে ঝুনু এবং কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মনিরুজ্জামান মৃধা।

নাসিরুল ইসলাম বোয়ালমারী উপজেলার সাতৈর ইউনিয়নের সাতৈর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা। মো. শামসুদ্দীন মিয়াও বোয়ালমারী সদরের হাসপাতাল সড়ক এলাকার ছোলনা মহল্লার বাসিন্দা। মো. মনিরুজ্জামান মধুখালী উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের আড়পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের রাজনীতি করেছেন।

(বাম থেকে ডানে) যুবদলের সাবেক সহসভাপতি মনিরুজ্জামান, কৃষকদলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম ও বোয়ালমারীর সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দীন মিয়া মৃধা

নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির হয়ে এই তিন নেতাকে তিনটি উপজেলায় গণসংযোগ করা, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা গেছে। গত ২৩ অক্টোবর এ আসনভুক্ত তিনটি উপজেলা ও তিনটি পৌরসভার ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ছয়টি কমিটির অনুমোদন দেয় জেলা বিএনপি। ওই কমিটিতে ‘খন্দকার নাসিরুলের সমর্থকদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এবং কমিটিগুলোতে আওয়ামী লীগের পদধারীদের স্থান দেওয়া হয়েছে’ বলে দাবি করে কমিটিগুলো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয় তিন উপজেলাজুড়ে। সর্বশেষ গত ৭ নভেম্বর সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। এ পাল্টাপাল্টি মামলার আসামি হয়েছেন নাসিরুল ও শামসুদ্দীন।

খন্দকার নাসিরুল বলেন, এ আসনে দল কেন প্রার্থী ঘোষণা দেয়নি, তা আমার থেকে দল ভালো বোঝে। কেন্দ্রীয় নেতারা আমাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছেন।

শামসুদ্দীন মিয়া বলেন, তিন উপজেলার বিএনপির যে কমিটিগুলো করা হয়েছে তাতে বিএনপির ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের স্থান দেওয়া হয়েছে। কমিটি বাতিলের জন্য আন্দোলন করছি। এ কারণে এ আসনের প্রার্থীর ঘোষণা বন্ধ রাখা হতে পারে। তবে প্রার্থী ঘোষণা না দেওয়ার মূল কারণ আমার জানা নেই। এটা দলীয় হাইকমান্ড জানে।

মনিরুজ্জামান মৃধা বলেন, এ এলাকার বিএনপিকে জনগণের কাতারে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি কাজ করছি। কয়েকজন নেতা এ এলাকার বিএনপিকে ধ্বংস করছেন, তাদের হাত থেকে বিএনপিকে উদ্ধার করে দলকে সংকটমুক্ত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মো. ইলিয়াস মোল্লা

নির্বাচনী মাঠে একমাত্র সক্রিয় জামায়াত

এ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ঢাকা জেলা জামায়াতের শূরা ও কর্মপরিষদ সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইলিয়াস মোল্লা।

এখানে সরব ও নীরব দুইভাবেই চলছে জামায়াতের প্রচারণা। তিনটি উপজেলায় সভা-সমাবেশের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় ভোটারদের দ্বারে দ্বারে বিরামহীনভাবে ছুটে চলছেন তিনি। করছেন মোটর শোভাযাত্রাও। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও তার সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে তিনি তার গণসংযোগের তথ্য ফেসবুকে প্রকাশ করছেন।

প্রার্থীর গণসংযোগের পাশাপাশি জামায়াতের নারীকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে প্রচারণা চালাতেও দেখা গেছে। দলের প্রচলিত ধারার বাইরে জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীদের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা ও সড়কে প্রার্থীর ছবি ও প্রতীকসম্বলিত তোরণও দেখা যাচ্ছে।

জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী মো. ইলিয়াস মোল্লা বলেন, আমি প্রায় এক বছর ধরে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরছি। সভা-সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছি। নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। এটি আওয়ামী লীগ প্রভাবিত এলাকা। গত বছরের পতন ও পরিবর্তনের পর আমি কোনো মামলা করিনি। আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কর্মী আমার দ্বারা নির্যাতনের শিকারও হয়নি।

প্রার্থিতা চূড়ান্ত না হলেও আশাবাদী এনসিপি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এখনও মনোনয়ন না দিলেও মাঠে সক্রিয় রয়েছে কয়েকজন নেতা। 

ফরিদপুর এনসিপির জ্যেষ্ঠ আহ্বায়ক এস এম জাহিদ বলেন, দল এখনও তো আমাদের চার আসনের কোনোটিতে আমাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি। আমাদের চারটি আসনে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী দলীয় প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়ন কিনেছেন। তবে এখন পর্যন্ত প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় আমাদের প্রার্থীরা এককভাবে মাঠে নামেনি বরং দলীয়ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের প্রচারণা খারাপ হচ্ছে না। আমি বলব গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা দল আমরা। আমাদের প্রতি মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা আছে। এটাই আমাদের জিতিয়ে আনবে।

দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষা, সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে জটিল সমীকরণ 

জাতীয় পার্টি মাঠে না থাকলেও ভোটের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা। জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি এস এম ইয়াহিয়া বলেন, দল নির্বাচনে অংশ নিলে ফরিদপুর-১ আসনে কেন্দ্রীয় যুব সংহতির যুগ্ম সম্পাদক আকরামুজ্জামান দলীয় প্রার্থী হবেন। ফরিদপুরের চারটি আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি তারা নিয়ে রেখেছেন। তবে জাতীয় পার্টি নির্বাচন করবে কি করবে না সে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। সে অপেক্ষায় আছেন তারা।

তবে ফরিদপুর-১ আসনের সঙ্গে মিশে আছে শাহ মো. আবু জাফরের নাম। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ক্ষমতাসীন দলের নেতা হিসেবে এ এলাকায় আধিপত্য বজায় রেখেছেন তিনি। এ আসনে তার ভোট ব্যাংকও রয়েছে। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে শাহ জাফর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) গঠন করে নির্বাচন করে পরাজিত হন।

শাহ মো. আবু জাফর বলেন, এই এলাকায় আমার নামের ওপর ভোট আছে। আমি নির্বাচন করলে ভালো করব বলে আশাবাদী। এলাকার নেতাকর্মীরা আমাকে নির্বাচন করতে চাপ দিচ্ছেন। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যদি বিএনপি আমাকে মনোনয়ন দেয় অথবা বিএনপি সমর্থিত জোটের প্রার্থী হতে পারি তাহলেই আমি নির্বাচন করব। বর্তমানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার মতো সামর্থ্য আমার নেই।

এছাড়া এই আসনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুফতি শারাফাত হোসাইন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ওয়ালিউর রহমান এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশের অর্থ সম্পাদক মুফতি মো. জাকির হোসাইন কাসেমী পোস্টার-বিলবোর্ড টানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০২৪) ফরিদপুর-১ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯৮১ জন। ত্রয়োদশ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ১৪৬ জন।

আরকে