অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিংয়ের একটি চিত্র

শুধুমাত্র মোবাইল ফোন দিয়েই তামিল সিনেমার আদলে অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও বানিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন মাদারীপুরের ছয় তরুণ। তাদের নেই কোনো পেশাদার ক্যামেরা বা ক্যামেরাম্যান। নিজেদের ব্যবহৃত একটি স্মার্টফোনেই করা হয়েছে অ্যাকশন দৃশ্যের শুটিং, ভিডিও এডিটিংসহ সব কিছু।

তারা দেখিয়ে দিয়েছেন বাজেট কোনো বড় বিষয় নয়, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে স্বল্প বাজেটে যে কোনো অ্যাকশন দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব। করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ সময়টাকে কাজে লাগিয়ে তামিল সিনেমার আদলে অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও বানিয়ে প্রশংসায় ভাসছেন এই তরুণরা। 
 
মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়নের সমিতির হাট এলাকার ছয় তরুণের তৈরি ভিডিও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। লাখ লাখ মানুষ দেখছে তাদের তৈরি অ্যাকশন ভিডিও। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সারাদিন খেলার মাঠে, সোশ্যাল মিডিয়ায় বা গেমস খেলে সময় নষ্ট না করে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা খেকেই এমন উদ্যোগ তাদের। 

ক্ষুদে নির্মাতাদের মনে প্রশ্ন- অন্য দেশের ইউটিউবাররা পারলে আমরা পারব না কেন? আর এই ইচ্ছে শক্তি নিয়েই প্রায় সাত মাস আগে এফএফ ফ্রেন্ডস ফরএভার (FF Friends Forever) নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল খোলেন তারা। আর এই  চ্যানেলেই নিয়মিত তাদের তৈরি অ্যাকশন ভিডিওগুলো আপলোড করে যাচ্ছেন তারা। 

নেই কোনো প্রশিক্ষণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে এখনো কলেজের গন্ডি পেরুতে পারেননি ছয়জনের কেউ। ক্যামেরাম্যান, ডিরেক্টর ও এডিটর হিসেবে কাজ করছেন সুফিয়ান খান। তিনি সবে এসএসসি পাস করেছেন। সহযোগী ক্যামেরাম্যান ও ডিরেক্টর  মো. তৌহিদুল ইসলাম বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। এছাড়া রয়েছেন মো. ইব্রাহিম ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আরিয়ান রুদ্র ও মো. শাকিব খান। এরা সবাই মাধ্যমিক কিংবা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী। তরুণ ক্ষুদে নির্মাতাদের দাবি- প্রশিক্ষণ আর প্রযুক্তির সহায়তা পেলে ভবিষ্যৎতে আরও ভালো কিছু করে দেখাতে পারবেন তারা।

কিছুদিন ধরে জনপ্রিয় তামিল সিনেমা বাহুবলি : দ্য বিগেনিং, দ্য রিটার্ন অব রেবেল, কেজিএফ চ্যাপ্টার-১ সহ আরও বেশ কিছু সিনেমা থেকে নেওয়া তাদের তৈরি অ্যাকশন দৃশ্যের ভিডিও নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে- সামান্য একটি স্মার্টফোন দিয়েই তামিল মুভির অ্যাকশন দৃশ্য অবিকল ধারণ করছে এই ক্ষুদে নির্মাতারা। দেখে মনে হতেই পারে দৃশ্যটি তামিল কিংবা ভারতের ইউটিউবারদের করা বা বিপুল বাজেটের অ্যাকশন ক্লিপ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ক্ষুদে তরুণদের প্রতিভা দেখে হতবাক সবাই।

উন্নত প্রযুক্তি নেই বলে হাল ছাড়েননি ক্ষুদে নির্মাতারা। সাধারণ একটি মোবাইলের ক্যামেরায় ধারণ করা হয় ভিডিও। শুটিংয়ে ব্যবহার করা হয় পথের ধুলা মিশ্রিত কিছু ময়দা ও কাঠের তৈরি দেশীয় খেলনা অস্ত্র। ভিডিও এডিটিংয়ের জন্য ব্যবহার হয় কাইনমাস্টার সফটওয়্যার। আকার ও প্রকারভেদে একটি ভিডিও তৈরি করতে সময় লাগে পাঁচ থেকে সাতদিন। সর্বশেষ ধারণকৃত অ্যাকশন দৃশ্যের সঙ্গে তামিল সিনেমার সাউন্ড ইফেক্ট জুড়ে দেওয়া হয়। আর তাতেই নিখুঁতভাবে ফুটে ওঠে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ক্ষুদে নির্মাতাদের তৈরি অ্যাকশন দৃশ্য।

তাদের তৈরি অ্যাকশন ভিডিও দেখে দেশের অনেক পেশাদার নির্মাতাদের কাজের মান নিয়েও সমালোচনার  ঝড় বইছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সারাদেশে তাদের তৈরি ভিডিও নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসায় ভাসছেন এই ছয় তরুণ। তবে অনেকে বলছেন, সারাদেশেই এখন কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য। তাদের তৈরি অ্যাকশন ভিডিও দেখে তরুণ প্রজন্ম অপরাধের দিকে ধাবিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এই তরুণ ক্ষুদে নির্মাতাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথম অবস্থায় পরিবারের কোনো সাপোর্ট না পেলেও পরবর্তীতে তারা তাদের পরিবারকে বুঝাতে সক্ষম হন ভবিষ্যতে তারা ভালো কিছু করবেন। এখন মানুষ তাদের প্রশংসা করছে। তবে তাদের পরিবার চাইছে তারা আগে পড়াশোনা করুক, পাশাপাশি বাকি কাজ চালিয়ে যাক। 

এলাকাবাসী জানায়, এমন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে তাদের সমাজের কিছু প্রতিভাবান তরুণ যে কাজটি করেছে সেটা গর্বের। তারা সামনের দিকে এগিয়ে যাক এমনটাই প্রত্যাশা এলাকাবাসীর। 

বাহুবলি সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যের নায়ক রুদ্র বলেন, আমরা প্রচুর পরিমাণে তামিল সিনেমা দেখতাম। তারপর মাথায় আসে অ্যাকশন দৃশ্য করার। আমরা দেখতাম ভারতের ইউটিউবাররা পারছে, তাহলে আমরা কেন পারব না।

ভিলেন চরিত্রের অভিনেতা মুরসালিন বলেন, আমি ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করি। এ কাজটি করতে গেলে আমাদের অনেক কষ্ট হয়। কারণ আমদের কোনো সেফটি নেই। আমাদের কাছে তেমন কিছুই নেই। রেডমি নোট ৭ প্রো মডেলের একটি মোবাইল দিয়েই আমারা কাজ করি। আমরা যদি আর্থিকভাবে একটু সাপোর্ট পেতাম তাহলে আরও ভালো কিছু করে দেখাতে পারতাম। 

ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান ও ভিডিও এডিটির  সুফিয়ান খান বলেন, করোনার কারণে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় আমরা আসলে গেম নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অনেকেই দেখেছি ইউটিউবিং করছে। আমরা তামিল সিনেমা খুব দেখতাম। আমাদের মাথায় আসে তামিল সিনেমার মত অ্যাকশন দৃশ্য ধারণ করবো। সারাদেশের মানুষ যে এটা এতো পছন্দ করবে তা আমারা ভাবতে পারিনি। আমার ভবিষ্যতে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চাই এ জন্য সকলের সহযোগিতা চাই।

সমিতির হাট ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি তাইজুল ইসলাম সাজ্জাদ বলেন, এরা সবাই আমার ছোট ভাই। আমি তাদের সবসময় বলি আগে পড়াশোনা ঠিক রাখতে হবে। আর এটাকে এখনো পেশা হিসেবে নেওয়া যাবে না। আমি তাদের প্রতিভাকে সাধুবাদ জানাই।  

কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন কলেজের বাংলা বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ইয়াকুব খান শিশির বলেন, মাদারীপুরের কালকিনি সমিতির হাট এলাকার কিছু তরুণ তামিল সিনেমার আদলে ফাইটিং দৃশ্য ধারণ করেছে, তাও শুধু মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাদের এই সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে আমি পজিটিভ মনে করছি। যেহেতু অনেকদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ সে ক্ষেত্রে তারা বখে যেতে পারতো, নেশাগ্রস্ত হতে পারতো। তারা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কাজটি করেছে আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। আমারা জানি সিনেমায় সাধারণত এ ধরনের দৃশ্য ধারণ করতে অনেক টাকা ব্যয় করা হয়। আমার মনে হয় যদি তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় তাহলে তারা বাংলা সিনেমাতে ভূমিকা রাখতে পারবে।

এ বিষয়ে কালকিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মেহেদী হাসান বলেন, এগুলো সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। কারণ এই মারামারি কাটাকাটি দেখে তরুণ সমাজ ভালো কিছু শিখবে না। আমাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসনের কথা হয়েছে, ওই তরুণদের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা করা হবে না।

আরএআর