আমাদের শিম গাছসহ ফুল ও শিম সব হলুদ হয়ে গেছে। এ বছর আমাদের শিম কোনো পাইকারই কিনবে না, এমনকি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি করা যাবে না। সার ও ওষুধ দিয়েও কিছু করতে পারিনি। আমরা লোকসানে পড়ে গেছি। লাখ টাকা করে একেক জন কৃষক দেনা হয়ে গেছে। এখন মরণ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই— কথাগুলো বলছিলেন বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া এলাকার ‘সবজি গ্রামের’ কৃষক আব্দুল মান্নান ফকির।

এ বছর প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করে শিম চাষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু ভাইরাসের আক্রমণে শিম গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় হতাশ হয়ে গাছ ছিঁড়তে ছিঁড়তে এসব কথা বলেন তিনি।

শুধু আব্দুল মান্নান ফকির নন, একই অবস্থা তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া এলাকার অন্তত দুই শতাধিক কৃষকের। কৃষকদের অভিযোগ, ভাইরাসের আক্রমণে শিম গাছের পাতা, ফুল ও শিম হলুদ হয়ে গেছে। এমন দুঃসময়ে তাদের খোঁজ নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কৃষি বিভাগ। ফলে চলতি মৌসুমে প্রায় ৭ কোটি টাকা ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ওই এলাকার শিম চাষিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে সমবায় পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে আসছেন তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া এলাকার কৃষকরা। এ কারণে এলাকাটি এখন ‘সবজি গ্রাম’ নামে পরিচিত। বর্তমানে বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিম চাষ হয় বরগুনার তালতলী উপজেলার এই এলাকায়। প্রতি বছর জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬ থেকে ৭ কোটি টাকার শিম বিক্রি করেন এখানকার কৃষকরা।

তবে চলতি মৌসুমে সওদাগরপাড়া এলাকার প্রায় ২২ একর জমির মধ্যে ২০ একর জমির শিম গাছে ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে। এতে গাছের পাতা, ফুল ও শিম হলুদ হয়ে যাওয়ায় প্রায় দুই শতাধিক কৃষক বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন।

শিম চাষ করে লোকসানের মুখে পড়া মো. আরিফ নামে এক কৃষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছর ভাইরাসের আক্রমণে আমাদের চাষ করা শিম গাছের পাতা হলুদ হয়ে গেছে। চেয়ারম্যান মেম্বার অথবা কৃষি কর্মকর্তাদের কোনো সহযোগিতা না পাওয়া আমরা শিম চাষ করে এখন বিপদে পড়েছি। এ বছর লাভের কোনো আশা দেখছি না, উল্টো আমার প্রায় লাখ টাকার লোকসান হবে। 

সওদাগর পাড়া এলাকার আরেক কৃষক সেলিম ফকির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সবাই কৃষি কাজ করেন। এ গ্রামের উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন জেলায় গেলেও এ বছর তা সম্ভব হবে না। তবে শিম গাছে ভাইরাস আক্রমণের পর নিজেদের টাকায় সার ওষুধ কিনে প্রয়োগ করেছি। সরকারিভাবে সহযোগিতা দেওয়ার কথা শুনলেও আমরা কোনো ধরণের সহযোগিতা পাইনি। আমার জমিতে প্রায় ১ লাখ টাকা করচ হয়েছে, কিন্তু গাছের যে অবস্থা তাতে ১৫ হাজার টাকার শিম বিক্রি করতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। 

একই এলাকার কৃষক মো. নাসির ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতি বছর আমাদের শিম দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি হয়। কিন্তু এবছর ভাইরাসের আক্রমণে সব শেষ হয়ে গেছে। শিম চাষ করতে একেকজন কৃষকের যে টাকা খরচ হয়েছে ওই পরিমাণ বিক্রিও হবে না। এ বছর কৃষিতে আমরা ব্যাপক টাকা লোকসানের মুখে পড়েছি।  

সওদাগর পাড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা শাহাদাত মাতুব্বর বলেন, এ বছর সবজি গ্রামের শিম চাষিরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। গত বছর এই এলাকার কৃষকরা শিম চাষে ভালো লাভ করলেও এবছর ভাইরাসের আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক কৃষকের ৬-৭ কোটি টাকা লোকসান হবে। তবে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও মাত্র একবার সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা এসে ঘুরে দেখে গেলেও পরে আর কোনো খোঁজ নেয়নি।

সওদাগার পাড়া এলাকার কৃষকদের শিম চাষে লোকসানের বিষয়ে বরগুনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক রথীন্দ্র নাথ বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরগুনার মধ্যে তালতলী উপজেলার সবজি গ্রামের কৃষকরা প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকার উৎপাদিত সবজি বিক্রি করেন। তবে এবছর ওই এলাকার কৃষকদের শিম গাছ হলুদ হয়ে যাওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই উপসহকারী এবং উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদেরকে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিকভাবে জেনেছি ভাইরাসের আক্রমণে শিম গাছগুলো হলুদ হয়ে গেছে। এরপরও সঠিক কারণ জানতে মাঠ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পটুয়াখালী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। 

সবজি গ্রামের কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, প্রতি বছর এক সবজি চাষ থেকে বিরত থাকতে হবে। বারবার একই সবজি চাষ করলে ভাইরাস আক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এ বছর কৃষকরা যে সবজি চাষ করবেন পরের বছর তা বাদ দিয়ে অন্য সবজি চাষ করতে হবে। তাহলে ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। 

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে যে কোনো প্রণোদনা পেলে আমরা কৃষকদের সহায়তা প্রদান করতে পারি। তবে কৃষকদের সংখ্যার তুলনায় প্রণোদনা প্রাপ্তির পরিমাণ কম থাকায় সকল কৃষককে সহায়তার আওতায় নিয়ে আসতে পারি না। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রদর্শনী আকারে কিছু কৃষককে  সহায়তা করা হয়। তবে যে কোনো সমস্যায় কৃষকদের সঠিক পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। 

আরকে