আজ ১৮ ডিসেম্বর। রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন সারা বাংলাদেশ বিজয়ের উল্লাসে মুখর, তখন রাজবাড়ীতে চলছিল তুমুল যুদ্ধ। ওই দিন রাজবাড়ীর দামাল সন্তানরা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর অবাঙালি বিহারিদের কবল থেকে জেলা শহরকে শত্রুমুক্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে মুক্তির স্বাদ পায় পদ্মা বিধৌত জেলা রাজবাড়ী।

জানা গেছে, রেল শহর হওয়ায় রাজবাড়ীতে ১৫ থেকে ২০ হাজার বিহারি ও অবাঙালির বসবাস ছিল। শহরের নিউ কলোনি, আঠাশ কলোনি, স্টেশন কলোনি ও লোকোশেড কলোনি এলাকায় তাদের বসতি ছিল। এই কারণেই পাকিস্তান আমলে রাজবাড়ীতে বিহারিদের দাপট ছিল প্রবল, বিপরীতে বাঙালিরা ছিল অসহায়।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে রাজবাড়ীতে বিহারি, পাকিস্তানি হানাদার ও অবাঙালিরা অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে ওঠে। তারা পুরো শহর দখল করে রাখে। পাকিস্তানি বাহিনী রাজবাড়ীতে প্রবেশের পর বিহারিরা তাদের সঙ্গে যোগসাজশে নির্বিচারে জ্বালাও-পোড়াও ও গণহত্যা চালাতে থাকে।

ডিসেম্বরের ৯ তারিখ শহরের লক্ষীকোল এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বিহারিদের গুলিতে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা রফিক, শফিক ও সাদিক শহীদ হন। ১৩ ডিসেম্বর বিহারিরা শহরের বিনোদপুর বিদ্যুৎ সরবরাহের এক প্রহরীকে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও রাজবাড়ী শহর তখনও অবাঙালি বিহারিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তারা ঘোষণা দেয়, সারাদেশ বাংলাদেশ হলেও রাজবাড়ী পাকিস্তান হয়ে থাকবে।

১৭ ডিসেম্বর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীর একাধিক দল রাজবাড়ীতে এসে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এ সময় শহিদুন্নবী আলম, ইলিয়াস মিয়া, সিরাজ আহম্মেদ, আবুল হাসেম বাকাউল, কামরুল হাসান লালী ও রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে শহর ঘিরে ফেলেন। পাশাপাশি জেলার পাংশা এলাকা থেকে জিল্লুল হাকিম, আব্দুল মতিন, নাসিরুল হক সাবু, আব্দুল মালেক, সাচ্চু ও আব্দুর রব তাদের দল নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। ১৮ ডিসেম্বর বিহারিরা শহরের রেললাইনের উত্তর পাশে অবস্থান নেয়। তারা রেলওয়ে লোকোশেড থেকে ড্রাই-আইস ফ্যাক্টরি পর্যন্ত মালগাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

মুক্তিবাহিনী শহরের দক্ষিণ দিক থেকে গুলি চালাতে থাকে। তবে মালগাড়ির কারণে তারা তেমন সুবিধা করতে পারছিল না। সে সময় গোলাম মোস্তফা ও আনিসুর রহমান আবি মাগুরার শ্রীপুর থেকে মর্টার এনে দেন। ওই মর্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করলে বিহারিরা পিছু হটে। পরাজয় অনিবার্য বুঝে তারা আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে ফরিদপুরের দিকে অগ্রসর হয়, তবে সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় শতাধিক বিহারি নিহত হয় এবং কয়েক হাজার বিহারি আত্মসমর্পণ করে। এর মধ্য দিয়ে রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত হয়। ওই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা দিয়ানত আলী শহীদ হন এবং ইলিয়াস হোসেন গুরুতর আহত হন।

রাজবাড়ী সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব বলেন, রাজবাড়ী ছিল অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। রেলের কর্মচারী হিসেবে অবাঙালি ও বিহারিরা এখানে বসবাস করত। তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। হানাদার বাহিনী বিহারিদের অস্ত্র সরবরাহ দিত। বিভিন্ন কৌশলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে। মূলত বিহারিদের কারণেই দুই দিন পরে রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত হয়।

রাজবাড়ী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খান মো. আলী ইমরান বলেন, যুদ্ধের সময় রাজবাড়ীতে অবাঙালি ও তাদের দোসর এবং পলাতক কিছু পাক হানাদার বাহিনী আশ্রয় নিয়ে বাঙ্কার তৈরি করে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে কারণেই তাদের পরাস্ত করতে দুই দিন বেশি সময় লেগেছিল।

তিনি আরও বলেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাজবাড়ীতে হানাদারমুক্ত দিবসে কোনো কর্মসূচি না থাকাটা দুঃখজনক। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে হয়তো তা হয় না। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দাবি, প্রতি বছর হানাদারমুক্ত দিবসটি যথাযথভাবে পালন করা হোক।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/এআরবি