১৯৭১ সালে আমার বয়স তখন ১৬ কি ১৭ হবে। টগবগে যুবক সেসময় আমি। মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলাম। ছাত্র হিসেবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না।

রাজবাড়ী ছিল বিহারি অধষ্যুত এলাকা। যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক আসলো তখন আমার মা বলল বিহারিরা তোকে মেরে ফেলবে তুই এখান থেকে চলে যা। মায়ের অনুপ্রেরণায় আমি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন আমার কাছে দুই/তিন টাকা ছিল। আমার মায়ের স্বর্ণের একটা বিছা ছিল। সেটার ৩০ ভরি মতো। সে তখন বলল বাবারে আমার তো আর দেওয়ার মতো কিছুই নেই, তুই এই বিছাটা নিয়ে যা। তখন মায়ের কাছ থেকে সেই বিছাটা নিয়ে আমি ভারত চলে যায়। ভারতে গিয়ে ২ টাকা থেকে ৩ টাকা ভরি সে হারটি আমি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি করি।এই পুঁজি নিয়ে আমি ভারতে অবস্থান করি। পরে সেখানে গেরিলা ট্রেনিং করে বাংলাদেশে ফিরে এসে যুদ্ধ অংশ নেই।

ঢাকা পোস্টের কাছে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু তালেব।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব রাজবাড়ী পৌরসভার ধুনচি এলাকার মৃত হাজী বদর উদ্দিনের ছেলে। বর্তমানে তিনি রাজবাড়ী সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব বলেন, ১৯৭১ সালের যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক দেওয়া হলো তখন আমরা তরুণ যুবকরা স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং শুরু করলাম। যখন আমরা শুনলাম পাকবাহিনীরা খুব অত্যাচার শুরু করল, মিলিটারিরা বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছিল, মা-বোনদের ওপর অত্যাচার ও ধর্ষণ, লুটপাট শুরু করলো তখন আমি জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে ভারতে চলে যাই। ভারতে গিয়ে আমরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণ শেষ করে আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসি। এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

আমার কমান্ডার ছিলো কুমারখালির মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিব এবং সহকারী ছিল আব্দুর রাজ্জাক। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি বাংলাদেশে ঢুকে রাজবাড়ীতে আসি। কিন্তু রাজবাড়ীতে কোনো গ্রুপ না পাওয়ার কারণে আমি কুমারখালি চলে যায়। সেখানেই পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ করি। পরে ১৬ ডিসেম্বরের আগে আমি রাজবাড়ীতে আসি।

তখন রাজবাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর ইলিয়াস সাহেবের দল, ডা. কামরুল হাসান লালীর দল, রফিকুল ইসলামের দল, বাকাউল আবুল হাসেমের দল, জলিল মাস্টারের দল, শহীদুন নবী আলমের দল ছিল। তখন রাজবাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাক বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হতে লাগল। এক পর্যায়ে পাক বাহিনী পালিয়ে গেল। কিন্তু রেলের শহর হওয়ায় রাজবাড়ীতে অনেক বিহারি বা অবাঙালীর বসবাস ছিল। পাক বাহিনী চলে গেলেও বিহারি বা অবাঙালী যারা ছিল তারা পাক বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। এই বিহারিরা রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে ষড়যন্ত্র করে বাড়িঘর লুটপাট, নারী ধর্ষণ করেছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে এসে তারা মেরে এই লোকশেড ইন্দিরার মধ্যে নিয়ে এসে ফেলতো।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, যখন পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেল তখন মেজর জিয়া রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিল। তখন রেডিওতে মেজর জিয়াকে বলতে শুনেছিলাম, আমি মেজর জিয়া বলছি। ইন্ডিপেন্ডেন্ট বাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমি তার নির্দেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। এমনটাই তখন শুনেছিলাম। তখন রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধের ডাক শুনে আমরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়লাম।

তিনি আরও বলেন, আমার চোখের সামনে দেখছি পাক বাহিনীরা বাঙালিদের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী মা-বোনদের ইজ্জত হরণ করছে, তারা লুটতরাজ করছে, নির্বিচারে মানুষকে হত্যা করছে, এটা দেখার পর কি একজন যুবক বসে থাকতে পারে। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিব। তখন আমরা এটা প্রতিহত করার চেষ্টা করি। তখন আমরা যারা যুবক ছিলাম তখন আমাদের মধ্যে ছিল যে আমরা তাদেরকে প্রতিহত করব, তাদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করব। সেই সুবাদেই আমরা ভারতের চলে যাই। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং বিজয়ী হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আবু তালেব যুদ্ধের সময়ের স্মৃতি মনে করে বলেন, যুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা হলো যখন ট্রেনিং করে ভারত থেকে দেশে আসিতেছিলাম তখন কোকো নামের একজন রাজাকার নারিকেল গাছে বসে মুক্তিবাহিনীর দিকে লক্ষ করে ফায়ারিং করতেছিল। তখন কয়েকজন মুক্তিবাহিনী মারা যায়। আমরা দেখি একটা লোক গাছের মাথায় বসে গুলি করছে। তখন আমরা ব্রাশফায়ার করে কোকো রাজাকারকে মেরেছিলাম।

আরেকটি স্মরণীয় ঘটনা হলো রাজবাড়ীতে আসার সময় বেলগাছিতে একটি রেলের ব্রিজ ছিল। ওই ব্রিজটা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বিহারিদের হত্যা করে মাটিতে পুতে ফেলা হয় এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। এটা আমার স্বচক্ষে দেখা।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ৯ মাস যুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করলাম। স্বাধীনতা একবারই হয়, বার বার হয় না।

রাজবাড়ী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য সচিব ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাকাউল আবুল হাসেম বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এই সঠিক ইতিহাসগুলো ভবিষ্যতে আরও প্রসার করা প্রয়োজন। আমরা কেন যুদ্ধ করেছিলাম, যুদ্ধের পরে আমরা কি চেয়েছিলাম, আমাদের আশা কি ছিল এই তথ্য সংগ্রহ ও লেখালেখি করা অবশ্যই প্রয়োজন। দেশে হয়তো মুক্তিযোদ্ধারা বেশিদিন বেঁচে থাকবে না, তাদের বয়স হয়ে গেছে। অনেকের বয়স একশ ছাড়িয়েছে। যারা দেশ নিয়ে ভাবেন, জাতি নিয়ে ভাবেন তাদের উচিত সঠিক ইতিহাস গুলো সংগ্রহ করেন।

তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধারা খুব শঙ্কিত অবস্থায় রয়েছে। যেহেতু এদেশে একটা সরকার পতন হয়েছে। এখানেও দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কেন্দ্র করেই এই পতনের সূত্রপাত। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা খুব শঙ্কিত, আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত। সামনে কি হবে এটা নিয়ে আমরা এখন খুব চিন্তিত। আমাদের দাবি বাংলাদেশে একটা দেশে গণতান্ত্রিক সরকার আসুক, নির্বাচন হোক। দেশে শান্তি ফিরে আসুক। দেশে অরাজকতা দূর হোক। দেশের মানুষ শান্তিতে বসবাস করুক। এটাই বর্তমান সরকারের কাছে চাওয়া পাওয়া।

আরকে