মানববন্ধনে হিন্দু মহাজোট নেতা
‘দীপু দাসকে পুলিশের হাতে তুলে দিলে এমন নির্মম মৃত্যু হতো না’
‘ময়মনসিংহের ভালুকায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে নিহত দীপু চন্দ্র দাসকে যদি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পুলিশের হাতে তুলে দিতো, তাহলে হয়তো এমন নির্মম মৃত্যু হতো না’- বলে অভিযোগ করেছেন ময়মনসিংহ জেলা হিন্দু মহাজোটের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা নৃপেষ রঞ্জন সরকার।
তিনি বলেন, আমরা জেনেছি ঘটনার সময় পুলিশ প্রস্তুত ছিল, তখন দীপু চন্দ্র দাসকে যদি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পুলিশের হাতে তুলে দিতো, তাহলে হয়তো তার এমন নির্মম মৃত্যু হতো না। কিন্তু পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কারখানা কর্তৃপক্ষ দীপু চন্দ্র দাসকে পুলিশের হাতে না নিয়ে উত্তেজিত জনতার হাতে তুলে দিয়েছে। আমরা এ ঘটনায় কোম্পানির মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের কঠোর বিচার দাবি করছি।
বিজ্ঞাপন
রোববার (২১ ডিসেম্বর) বিকেল ৪টায় ময়মনসিংহ নগরীর শহীদ ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে সচেতন সনাতনী সমাজের ব্যানারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে তিনি এই অভিযোগ করেন।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে আরও বক্তব্য রাখেন জেলা হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক ডা. এনসি পাল, সংগঠনটির তারাকান্দা উপজেলা শাখার সভাপতি লিমন দেবনাথ, লিমন পাল, সঞ্জয় দত্ত, শঙ্কর সাহা প্রমূখ।
বিজ্ঞাপন
মানববন্ধনে নিহত দীপু চন্দ্র দাসের প্রতিবেশি লিমন দেবনাথ বলেন, নিহত দীপু চন্দ্র দাস ঋষি জাতের মানুষ। সে আমার প্রতিবেশী। অনেক ভালো ছেলে ছিল। তাদের পরিবারে কোনো শিক্ষিত লোক নেই, একমাত্র বিএ পাস করা ছেলে ছিল দীপু। গত দুই বছর আগে সে বিয়ে করেছে, এক বছর বয়সী তার একটি সন্তান আছে। ব্যক্তি জীবনে সে অনেক সচেতন মানুষ ছিল, সে কখনো ধর্ম অবমাননা করতে পারে না। কিন্তু ধর্ম অবমাননার ট্যাগ দিয়ে তাকে বীভৎসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যেন ট্যাগ দিয়ে এ ধরনের জঘন্য কাজ আর কেউ করতে সাহস না পায়।
লিমন দেবনাথ আরও বলেন, শুনেছি এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের কি বিচার হবে আমরা জানি না। তবে আমার দাবি- কোম্পানি যেন দীপু চন্দ্র দাস মৃত্যুর উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়। যা নিয়ে তার পরিবার খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারে।
নারায়ণ পাল নামের অপর এক নেতা বলেন, দীপু চন্দ্র দাসকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কী দোষ করেছিল দীপু চন্দ্র দাস, তা এখনো আমরা জানতে পারিনি। এ ঘটনায় দায়ী কারা ? আমরা কাকে দায়ী করব- সরকার না প্রশাসন। জানি আমাদের এই মানবন্ধনে হয়তো কিছুই হবে না। কিন্তু আমারা এই হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করছি।
জেলা হিন্দু মহাজোটের সাধারণ সম্পাদক ডা. এনসি পাল বলেন, কোনো সুস্থ মানুষ এই হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড দেখে ঠিক থাকতে পারবে না। একটি মানুষকে হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলিয়ে আগুনে পোড়ানোর ঘটনা মেনে নেওয়ার মতো না। এ ধরনের মানবতাবিরোধী কাজ আমরা মানতে পারছি না। এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের ফাঁসি দাবি করছি।
এছাড়া মানববন্ধনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও সংগঠনের প্রায় শতাধিক নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তারা ব্যানার, ফেস্টুনে দীপু চন্দ্র দাস হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে ভালুকার জামিরদিয়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড কারখানায় ধর্ম অবমাননার অভিযোগে দিপু চন্দ্র দাসকে (২৮) পিটিয়ে এবং আগুন ধরিয়ে হত্যা করে উত্তেজিত জনতা। এ ঘটনায় ১৯ ডিসেম্বর নিহতের ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে ভালুকা থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় ইতোমধ্যে ১২ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের মদ্যে ৩ জনের বিরুদ্ধে ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। আগামীকাল সোমবার ভালুকা আমলি আদালতে এই রিমান্ড শুনানি হবে বলে জানিয়েছেন জেলার আদালত পরিদর্শক (ওসি) পীরজাদা শেখ মো. মোস্তাছিনুর রহমান।
ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, অপরাধ করলেও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারো নেই। কেন ওই যুবককে পুলিশের হাতে না দিয়ে জনতার হাতে তুলে দেওয়া হলো, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে র্যাব ও পুলিশের অভিযানে অনেকেই গ্রেপ্তার হয়েছে বাকিদের গ্রেপ্তার অভিযান চলছে।
নিহতের বাবা রবি চন্দ্র দাস ও বোন চম্পা দাসের দাবি, উৎপাদন বৃদ্ধি নিয়ে বিরোধের জেরে পরিকল্পিতভাবে দিপুকে মিথ্যা অপবাদে হত্যা করা হয়েছে। তাদের দাবি- দিপু শিক্ষিত এবং ধর্ম সচেতন ছিলেন। তিনি এমন কাজ (ধর্ম অবমাননা) করতে পারেন না।
নিহত দিপু চন্দ্র দাস (২৮) জেলার তারাকান্দা উপজেলার মোকামিয়া কান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। দুই বছর ধরে তিনি এই কোম্পানিতে কাজ করছিলেন।
সূত্র জানায়, পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেডের মালিক বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বাদশা মিয়া। তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ভালুকা এলাকার বনভূমির জমি জালিয়াতির মাধ্যমে জবরদখল করে গড়ে তুলেছেন শিল্প সাম্রাজ্য। তার এই ক্ষমতার পেছনে মদদ দিতেন তৎকালীন পুলিশের আইজি বেনজির আহম্মেদ এবং একেএম শহীদুল হক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শিল্প সেক্টরসহ দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কোম্পানি কর্তৃপক্ষ পরিকল্পিতভাবে দীপু চন্দ্র দাস হত্যার ঘটনায় ইন্ধন রয়েছে।
আমান উল্লাহ আকন্দ/আরকে