নোয়াখালীতে ধীরে ধীরে জেঁকে বসছে শীত। সেই সঙ্গে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি)। শীতের আবহে ভিন্ন এক রূপে ধরা দিয়েছে সবুজে ঘেরা ১০১ একর বিস্তৃত এই ক্যাম্পাস।

মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো এলাকা ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে। আগে শীত অনুভূত হলেও কুয়াশার তেমন দেখা না মিললেও গত কয়েকদিন ধরে ক্যাম্পাসজুড়ে তীব্র কুয়াশা পড়তে দেখা যাচ্ছে। এতে শীতের তীব্রতাও বেড়েছে।

সবুজে ঘেরা নোবিপ্রবি ক্যাম্পাস গ্রামীণ আবহে নির্মিত হওয়ায় শীতের মৌসুমে এর সৌন্দর্য আরও অনন্য হয়ে ওঠে। নানান প্রজাতির ফুলের সৌরভে মুখরিত থাকে ক্যাম্পাস। সকালে ঘুরে দেখা যায়, কুয়াশার কারণে এক আবাসিক হল থেকে অন্য হল কিংবা একাডেমিক ভবন থেকে অন্য ভবন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিছু দূর গেলে মানুষও চোখে পড়ে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস গেট, গোলচত্বর, প্যারিস রোড ও নীল দিঘির পাড়—সবকিছুই যেন প্রকৃতিপ্রেমীদের ডেকে নিচ্ছে শীতের সকালের রূপ-রস উপভোগে। কুয়াশায় মোড়া মৃদু আলো ক্যাম্পাসের প্রকৃতিকে করে তুলেছে আরও রহস্যময় ও মোহনীয়। গাছের পাতা ও ঘাসের ডগায় জমে আছে শিশির।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছের ফাঁক গলে সূর্যের কোমল কিরণ শিশির ভেজা ঘাসে এসে পড়ে। তখন ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটে যায়। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়া যায় খোলা বাতাসে। শীতের ছোঁয়ায় ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য যেন আরও বহুগুণে বেড়ে গেছে। গোলাপ, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, অ্যাস্টার, সিলভিয়া, জিনিয়া ও গাঁদাসহ নানা প্রজাতির ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা।

সকালে তীব্র কুয়াশার মধ্যে হাঁটতে বের হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল আরেফিন সাজিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কয়েকদিন ধরে প্রচুর কুয়াশা পড়ছে। এই কুয়াশায় ক্যাম্পাসটা অতিরিক্ত সুন্দর লাগছে। ছোটবেলায় কুয়াশা উপভোগ করার সুযোগ পাইনি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেটা উপভোগ করতে পারছি। তাই সকাল সকাল খালি পায়ে বের হয়েছি। স্মৃতিতে ১০১ একরের শীতের সকাল থেকে যাবে সব সময়। 

ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী হাসান শরীফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নোবিপ্রবির ১০১ একর ক্যাম্পাস সৌন্দর্যের লীলাভূমি। সকালের কুয়াশা সেই সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অনেকেই কুয়াশার সঙ্গে ছবি তুলতে আসে, আমিও ছবি তুলতে বের হয়েছি। 

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন শাখার চালক মো. মিলন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোর থেকেই ঘন কুয়াশা পড়ে যায়। বিশেষ করে সকাল ৬টা থেকে ৮টা পর্যন্ত কুয়াশার ঘনত্ব এতটাই বেশি থাকে যে গাড়ির সামনের অংশ স্পষ্ট দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই আমাদের বাধ্য হয়ে হেডলাইট জ্বালিয়ে এবং খুব ধীরে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। শীতও আগের তুলনায় বেশ অনুভূত হচ্ছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা ধীরে ধীরে কেটে যায়। তখন আবার দিনের বেলায় কিছুটা গরম অনুভূত হয়।

নোবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইসমাইল বলেন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে দিয়েছে এক অপার্থিব মুগ্ধতা। মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজ হাতে এঁকে দিয়েছে স্বর্গীয় সৌন্দর্যের ক্যানভাস। কুয়াশার আড়ালে এসে ভিড় করেছে শীতের পাখিরা, আর তাদের কলরবে প্রাণ ফিরে পেয়েছে নোবিপ্রবি ক্যাম্পাস। ১০১ একর বিস্তৃত এই ক্যাম্পাস এমনিতেই সৌন্দর্যের লীলাভূমি, আর সকালের কুয়াশায় সেই সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে আরও মোহনীয়, আরও স্বপ্নীল।

এদিকে নোয়াখালীতে দিন দিন তাপমাত্রা কমে শীতের প্রকোপ বাড়ছে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে পথঘাট ও প্রকৃতি। গত এক সপ্তাহ ধরে জেলার তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গরম কাপড় ও লেপ-তোষকের চাহিদা। মৌসুমের শুরুতেই মানুষ ভিড় করছেন গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে এবং সাধ্যমতো শীতবস্ত্র সংগ্রহ করছেন। 

জানা গেছে, দিনের বেলায় তাপমাত্রা তুলনামূলক সহনীয় থাকলেও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঠাণ্ডা বেশি অনুভূত হয়। এ সময় বিস্তীর্ণ এলাকা ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে। ফলে যাত্রী ও চালকদের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।

অন্যদিকে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে শীত ও কুয়াশার কারণে খেতমজুর ও দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষগুলো পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। সময়মতো কাজে যেতে না পারায় তাদের আয়েও প্রভাব পড়ছে। শীতের কবলে পড়েছে নদ-নদী তীরবর্তী চর ও দ্বীপচরের হতদরিদ্র মানুষজন।

সদর উপজেলার কৃষক রবিউল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোরের দিকে কুয়াশার কারণে জমিতে যেতে অনেক সময় দেরি হয়ে যায়। চোখের সামনে কিছুই পরিষ্কার দেখা যায় না। তারপরও সংসার চালানোর তাগিদে মাঠে নামতে হচ্ছে। কুয়াশার মধ্যেই জমিতে গিয়ে ফসলের অবস্থা দেখছি, টুকটাক পরিষ্কার করছি। গতবার ফসল ভালো হয়নি, অনেক ক্ষতি হয়েছে। এবার যেন ভালো ফলন হয়—এই আশায় বেশি সময় দিচ্ছি। শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করেই কাজ করতে হচ্ছে।

নোয়াখালী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন,  গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ১৫ থেকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছে। তবে এটিকে এখনো পুরোপুরি শীত বলা যাবে না। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে উত্তর দিক থেকে হিমেল বাতাস প্রবাহিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন তাপমাত্রা আরও কমে শীতের তীব্রতা বাড়তে পারে।

নোয়াখালী সিভিল সার্জন ডা. মরিয়ম সিমি ঢাকা পোস্টকে বলেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ সময় তাদের উষ্ণ পোশাক পরানো, ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সর্দি, কাশি, জ্বর বা শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।

হাসিব আল আমিন/আরকে