কোপা শামছুর মরদেহ না পেয়ে পরিবারের আহাজারি, জড়িতদের বিচার দাবি
আমার বাবাকে জমি দেওয়ার কথা বলে মনির মেম্বার জাগলার চরে নিয়ে গেছে। সঙ্গে আমার ভাইও ছিল। আমার ভাইয়ের মরদেহ পেয়েছি, কিন্তু আমার বাবার কোনো খোঁজ পাইনি। তাকে বাগানের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জীবিত অথবা মৃত যে অবস্থাতেই হোক, আমরা আমার বাবার সন্ধান চাই।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) দুপুরে হাতিয়া থানার সামনে এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন জাগলার চরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিখোঁজ শামছুদ্দিন ওরফে কোপা শামছুর ছেলে মো. ফখরুল ইসলাম।
বিজ্ঞাপন
নিখোঁজ মো. শামছুদ্দিন হাতিয়া উপজেলার জাহাজমারা ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ছায়দুল হকের ছেলে। তার কলেজপড়ুয়া সন্তান মোবারক হোসেন শিহাবসহ মোট পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
অন্যান্য নিহতরা হলেন- সুখচর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চর আমান উল্যাহ গ্রামের মহিউদ্দিনের ছেলে আলাউদ্দিন, হাতিয়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম লক্ষিদিয়া এলাকার মৃত শাহী আলমের ছেলে হক সাব, মো. কামাল উদ্দিন এবং সুবর্ণচর উপজেলার চরবাটা ইউনিয়নের দক্ষিণ চর মজিদ এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে আবুল কাশেম।
বিজ্ঞাপন
শামছুদ্দিনের স্ত্রী মাহফুজা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী একজন ভালো মানুষ। জমিতে চাষাবাদ করে আমাদের সংসার চলত। ভূমিহীন হিসেবে জমি দেওয়ার কথা বলে তাকে জাগলার চরে নেওয়া হয়। সঙ্গে আমার ছেলেও ছিল। ছেলের সামনেই ওরা আমার স্বামীকে মারধর করে, পরে গুলি করে। আমি আমার ছেলের শেষ কথাও শুনতে পারিনি। আমি আমার স্বামীর সন্ধান চাই জীবিত অথবা মৃত। পাশাপাশি অপরাধীদের বিচার চাই।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) সকাল ১০টার দিকে হাতিয়া উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডসংলগ্ন জাগলার চরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়। গোলাগুলিতে পাঁচজন নিহত হন এবং অন্তত ৮ থেকে ১০ জন আহত হন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, জাগলার চরের জমি এখনো সরকারিভাবে কাউকে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়নি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত ৫ আগস্টের পর জাহাজমারা ইউনিয়নের কোপা সামছু বাহিনী প্রতি দাগ ২০ হাজার ৫০০ টাকায় জমি বিক্রি শুরু করে। পরে সুখচর ইউনিয়নের আলাউদ্দিন বাহিনী ওই জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং আরও বেশি দামে জমি বিক্রি করে। এতে দুই পক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়।
অভিযোগ রয়েছে, চর দখলের সঙ্গে যুক্ত ডাকাত আলাউদ্দিনের সঙ্গে সুখচর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সভাপতি বেলায়েত হোসেন সেলিম, আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম মেম্বার এবং বিএনপি নেতা নবীর ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের সহযোগিতায় আলাউদ্দিন বাহিনী কোপা সামছু বাহিনীকে বিতাড়িত করতে তৎপর হয়।
মঙ্গলবার সকালে কোপা সামছু বাহিনী, আলাউদ্দিন বাহিনী ও ফরিদ কমান্ডারের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থানে গেলে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। এতে আলাউদ্দিনসহ পাঁচজন নিহত হন। এরপর ফরিদ ডাকাত তার বাহিনী নিয়ে পালিয়ে যায়।
এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর হাতিয়া উপজেলায় দেওয়া এক বক্তব্যে চর জাগলা ও চর আতাউরে সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে হুঁশিয়ারি দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক এবং নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের প্রার্থী আব্দুল হান্নান মাসউদ। ৩৮ সেকেন্ডের এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, চর জাগলা ও চর আতাউরে সন্ত্রাসীদের এনে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলে তারা কার জমি কাকে দিচ্ছে। সরকারি জমি কি চাইলেই কেউ বুঝিয়ে দিতে পারে? সব ডাকাতকে একত্র করা হয়েছে। প্রশাসনকে বহুবার বলেছি, আজ আবারও বলছি অতি দ্রুত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আমরা আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। যদি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপনাদের কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাহলে এত বলার পরও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?
স্থানীয় বাসিন্দা মিরাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাগলা চর বিক্রির সঙ্গে একটি সংঘবদ্ধ চক্র জড়িত। মুশফিক, ফখরুল, ফরিদ, সামছু, মনিরসহ আলাউদ্দিন ডাকাত গ্রুপ সক্রিয়। মুশফিক ১ নম্বর হরণী ইউনিয়নের সাবেক প্রশাসক। তার জলদস্যু বাহিনী এখনো সক্রিয়। মুশফিক ও ফরিদ কমান্ডার আত্মীয়।
আরেক বাসিন্দা হাছান উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে এই চরে বিশৃঙ্খলা চলছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। জমি দেওয়ার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করা হয়েছে। মনির মেম্বারসহ একাধিক ব্যক্তি এই চরের জমি বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এখানে শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক নেতাও জড়িত। প্রাণহানির সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, লাশ গোপন করা হয়েছে।
এদিকে অভিযোগ অস্বীকার করে হরণী ইউনিয়নের সাবেক প্রশাসক মুশফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি রাজনৈতিক সভা করেছি, কোনো জমি বিক্রি করিনি। আমার সঙ্গে কারও হামলার সম্পর্ক নেই। আমি এসবের সঙ্গে জড়িত নই।
অন্যদিকে মনির উদ্দিন মেম্বারের মুঠোফোন বন্ধ থাকায় তার মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তার ভাই কামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিহিংসাবশত আমার ভাইয়ের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে। আমার ভাই এলাকায় নেই, প্রায় ছয় মাস ধরে বাইরে আছে।
হান্নান মাসউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভূমিদস্যুতার শেষ কোথায়? প্রশাসনের সহায়তায় প্রকৃত ভূমিহীনদের মাঝে জমি বুঝিয়ে না দিলে চর জাগলার মতো জায়গায় একের পর এক লাশ পড়তেই থাকবে। ভূমিহীনদের জমি বুঝিয়ে দেওয়ার কারণে আমার ওপর একাধিকবার হামলার চেষ্টা হয়েছে এবং সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।
নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা পাঁচটি মরদেহ উদ্ধার করেছি, এর মধ্যে শামছুদ্দিনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। একজন আহত রয়েছেন, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মরদেহগুলো নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। বর্তমানে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
হাসিব আল আমিন/এআরবি