ঠাকুরগাঁওয়ে একাধিক অভিযোগ থাকা ব্যক্তির মামলায় সাংবাদিক কারাগারে
সাংবাদিক আশরাফুল আলম। ছবি : সংগৃহীত
ঠাকুরগাঁওয়ে একের পর এক ‘মিথ্যা অভিযোগে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলার মাধ্যমে সাংবাদিকদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ নতুন নয়। তবে সর্বশেষ রাণীশংকৈলে উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি আশরাফুল আলমকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক ব্যক্তি ও বিমা কর্মী মাসুদ রানার দায়ের করা ‘মিথ্যা অভিযোগে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ মামলার ঘটনায় জেলার সাংবাদিক সমাজে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।
বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হাজিরা দিতে গেলে ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে আশরাফুল আলমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অথচ মামলা দায়ের করা বিমা কর্মী মাসুদ রানা, যার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে, তিনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, গত ৩ জুলাই ঠাকুরগাঁও আদালতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলাটি দায়ের করেন মাসুদ রানা। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজেকে কখনো ব্যবসায়ী, বিমা কর্মী আবার কখনো রাজনৈতিক নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা, হুমকি প্রদান ও ভুয়া পরিচয় ব্যবহারের একাধিক অভিযোগ এবং সাধারণ ডায়েরি (জিডি) থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
রাণীশংকৈলে উপজেলার সাংবাদিকদের অভিযোগ, ভুয়া পরিচয়ধারী এই বিমা কর্মী দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ভয়ভীতি প্রদর্শন, হুমকি এবং মিথ্যা মামলার মাধ্যমে এলাকায় ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে আসছেন। তার কালো টাকার পাহাড় ও অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেই সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
সাংবাদিক নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যার বিরুদ্ধে একাধিক জিডি, হুমকিমূলক অডিও ক্লিপ এবং প্রতারণার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তার দায়ের করা মামলায় একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো ন্যায়বিচারের চরম পরিহাস।
রাণীশংকৈল প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠন অবিলম্বে আশরাফুল আলমের নিঃশর্ত মুক্তি, মিথ্যা অভিযোগে মামলা প্রত্যাহার এবং ভুয়া পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছে। একইসঙ্গে দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণাও দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানভির হাসান তানু বলেন, একজন ভুয়া পরিচয়ধারী ব্যক্তির দায়ের করা মামলায় সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো শুধু অন্যায় নয়, এটি পুরো সাংবাদিক সমাজের জন্য অশনিসংকেত। যার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতারণা ও হুমকির অভিযোগ রয়েছে, তার মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকৃত সাংবাদিককে জেলে পাঠানো ন্যায়বিচারের চরম পরিহাস। এটি সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি আঘাত। আজ আশরাফুল আলম, কাল যে কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একই কৌশল প্রয়োগ করা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করা হলে ঠাকুরগাঁওয়ে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা টিকে থাকবে না। আমরা অবিলম্বে মিথ্যা অভিযোগের এই মামলা প্রত্যাহার এবং সাংবাদিক আশরাফুল আলমের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।
আশরাফুল আলমের স্ত্রী বলেন, আমার স্বামী অপরাধী নন, তিনি একজন সৎ সাংবাদিক। সত্য লেখাই যদি অপরাধ হয়, তাহলে এই সমাজে ন্যায়বিচার কোথায়? আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তিনি হাজিরা দিতে গিয়েছিলেন। তার হাতকড়া পরা অবস্থার এই দৃশ্য আমাদের সন্তানরা কোনোদিন ভুলতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, মিথ্যা অভিযোগের একটি মামলায় আজ আমাদের সংসার ভেঙে পড়েছে। ঘরে ফিরে ‘বাবা নেই’—এই প্রশ্নের উত্তর আমরা সন্তানদের কীভাবে দেব? আমরা শুধু চাই, সত্যটা যেন সামনে আসে এবং একজন নিরপরাধ মানুষ যেন দ্রুত মুক্তি পান।
রাণীশংকৈল প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মোবারক আলী বলেন, এটি কোনো ব্যক্তিগত বিরোধের বিষয় নয়, এটি সরাসরি সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। একজন দায়িত্বশীল সাংবাদিককে মিথ্যা অভিযোগে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় কারাগারে পাঠানো আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে সাংবাদিকতার নাম ভাঙিয়ে যেভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ উঠছে, তা প্রশাসনের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত ছিল। দ্রুত এই মামলা প্রত্যাহার এবং সাংবাদিক নেতা আশরাফুল আলমের নিঃশর্ত মুক্তি নিশ্চিত না হলে সাংবাদিক সমাজ আরও কঠোর কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হবে।
এ বিষয়ে রাণীশংকৈল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমানুল্লাহ আল বারী বলেন, মামলাটি আদালতে বিচারাধীন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আইনানুগ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষে সত্যতা যাচাই করে পরবর্তী আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সিভিল জজ) মজনু মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। একজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি মিথ্যা অভিযোগে মামলার শিকার হন, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সাংবাদিকদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া জরুরি।
তিনি আরও বলেন, শুনেছি মামলার বাদীর বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। জিডি করার পরেও তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়াও দুঃখজনক। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিৎ। ভুক্তভোগী সাংবাদিক আইনগত সহায়তা চেয়ে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে দরখাস্ত দাখিল করলে এবং বিধি মোতাবেক সহযোগিতা দেওয়ার সুযোগ থাকলে লিগ্যাল এইড অফিস থেকে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা প্রদান করা হবে।
রেদওয়ান মিলন/এএমকে