বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের নগরী কক্সবাজার। যে শহর ২৪ ঘণ্টায় আলোয় আলোকিত থাকতো হঠাৎ সেই শহর পরিণত হয়েছে এক প্রকার ভুতুড়ে অন্ধকারের নগরীতে। আলোর ঝলকানিতে থাকা শহর হঠাৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত। সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনের খবরে সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট্যরা। বন্ধ সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেলও। যার ফলে আলোর দেখা নেয় নগরীর লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ কয়েকটি পয়েন্টে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এসব পয়েন্টে থাকতো আলোর ঝলকানি।

শহর ঘুরে দেখা যায়
রাত আটটার পর থেকে বন্ধ দোকানপাট ও হোটেল-মোটেল। নেই কর্মচারী-কর্মকর্তাদের আনা-গোনা। কিছু কিছু হোটেলে রয়েছে শুধুই নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা। প্রায় ৩০ হাজার কর্মী ছাটায় আতঙ্কে রয়েছে। সড়কে সীমিত আকারে চলছে অভ্যন্তরীণ যানবাহন। তেমন দেখা নেয় দূরপাল্লার যানবাহনের। যে শহর পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকতো রাত-দিন, সেই শহরে নেই মানুষের আনাগোনা। পুরো হোটেল-মোটেল জোনের এমন পরিস্থিতি দেখে হতবাক সবাই। মূলত গেল সোমবার (২৮ জুন) থেকে সরকার সারাদেশে সীমিত ও আগামী বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর হওয়ার খবরে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে হোটেল-মোটেল মালিকরা।

লকডাউনে পর্যটনখাতের লোকসান
পর্যটন শিল্পে চরম সংকট এনে দিয়েছে করোনা। করোনার সংক্রমণ রোধ ও সর্বাত্মক লকডাউন বাস্তবায়নের প্রভাবে প্রায় দেড় বছরে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পর্যটন জোন ও শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, কয়েকশ' শুঁটকি ও শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি পণ্য বেচাবিক্রির দোকানপাটসহ পর্যটনের সকল অনুষঙ্গ মিলিয়ে এই ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তারা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে বা স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিতের কঠোরতায় পর্যটন ব্যবসা খুলে দেয়া না হলে এ ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গেল প্রায় দেড় বছরে কক্সবাজারে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পর্যটনের অর্থনীতি নিম্নমুখী। আমাদের হিসাবে প্রতিদিন ৪৫ হতে ৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে। এভাবে আরো কিছুদিন চলতে থাকলে আরও ধস নামবে। ইতোমধ্যে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে নতুন করে লকডাউন এ ব্যবসায় চরম সংকট সৃষ্টি করবে।

তিনি আরও বলেন, প্রণোদনার পাশাপাশি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের ভ্যাট ও কর মওকুফের আবেদনও করা হবে। এছাড়াও কীভাবে ব্যাংক ঋণের চাপ কমানোর ব্যবস্থা করা হবে।

কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সম্পাদক মুকিম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ৫২টি। আমরা করোনার সংক্রমণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। তারপরও কর্মচারীদের মানবিক দিক বিবেচনায় নিতে হবে, হোটেল-মোটেল বন্ধ থাকায় ৫২টি হোটেল ও রিসোর্টের অন্তত পাঁচ হাজার কর্মচারী বেকার জীবন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ কর্মচারীর বেতন-ভাতাও পরিশোধ হয়নি। এরমধ্যে নতুন বিধিনিষেধ হয়তো বড় সংকট তৈরি করবে। একেবারে ভুতুড়ে অবস্থা। সবকিছু বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে মালিকরা।

ট্যুরস ওনার্স এসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন। তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন দূরপাল্লার অনেক বাস ও ১০-১২টি ফ্লাইট যাতায়াত করে। পর্যটক সেবায় থাকা হোটেল-মোটেল, কটেজ ও রেস্টুরেন্ট ও বিমান চলাচল সবই গেল দেড় বছরে সুবিধা করতে পারেনি। এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যবসা ভেস্তে গেছে।

বেকার হবে ৩০ হাজার কর্মী
এদিকে, হোটেল-মোটেল অফিসার্স এসোসিয়েশনেরর তথ্য মতে, শহরের হলিডে মোড় হতে কলাতলীর দরিয়ানগর সৈকত এলাকা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ রয়েছে সাড়ে চার শতাধিক। পহেলা এপ্রিল থেকে কোনো হোটেলে অতিথি নেই। লকডাউনের ঘোষণা জানতে পেরে অধিকাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিলের আগেই ৯৩ শতাংশ কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে। বর্তমানে পাঁচ থেকে ৭ শতাংশ কর্মচারী হোটেল-মোটেলে অবস্থান করে সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন। নতুন করে বিধি নিষেধের ঘোষণা তাদেরকেও হতাশ করেছে।

তবে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকার ঘোষিত লকডাউন বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসন কঠোরভাবে কাজ করছে। সেই সঙ্গে হোটেল-মোটেল জোনে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বেকায়দায় পড়ছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদেরকে বিশেষ প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।

প্রসঙ্গত, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গেল পহেলা এপ্রিল থেকে নতুন করে কক্সবাজারের সকল পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক হয়নি এ ব্যবসার কার্যক্রম। গেল ২৪ জুন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ৫০ ভাগ হোটেল-মোটেল খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু সেটি আর দীর্ঘ পথ দেখেনি। তারমধ্যে নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার।

এমএএস