পদ্মা-যমুনা নদী বেষ্টিত জেলা মানিকগঞ্জ। বর্ষায় এ দুটি নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জেলার অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানিও বাড়ে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। তখন নিম্নাঞ্চল এলাকার মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হয়ে উঠে ডিঙ্গি নৌকা। তাই বর্ষার আগমনী বার্তায় মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় জমে উঠতে শুরু করেছে ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকার হাট।

জানা গেছে, জেলার চারপাশে ছোট-বড় বেশ কয়েকটি নদী বয়ে গেছে। এর মধ্যে হরিরামপুর উপজেলা ঘেঁষে বয়ে গেছে প্রমত্ত পদ্মা, দৌলতপুর ও শিবালয় উপজেলা ঘেঁষে বয়ে গেছে যমুনা আর ঘিওর ও সদর উপজেলার মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে কালিগঙ্গা নদী। এ ছাড়া ধলেশ্বরী ও গাজিখালি, ইছামতি নদীও জেলার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে বয়ে গেছে। যার কারণে বর্ষার শুরুতেই এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে থাকে। এ জন্য এসব নিম্নাঞ্চলের মানুষের মালামাল পরিবহন ও যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয়ে উঠে এই ডিঙ্গি নৌকা।

মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পুরোনো ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম হলো শতবর্ষী এই নৌকার হাট। উপজেলার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠে জমে উঠতে শুরু করেছে এই নৌকার হাট। প্রতি বুধবার বসে এই হাট। এ দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ডিঙ্গি নৌকা বিকিকিনি। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাকডাকে সরগরম থাকে হাট। 

সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে নৌকাগুলো। বর্ষার আগমনী বার্তায় জেলার নিম্নাঞ্চল ও আশপাশের অঞ্চলের মানুষ নৌকা কিনতে এসেছেন এই হাটে। জেলার বাইরে টাঙ্গাইলের নাগরপুর, সিরাজগঞ্জ এবং সাভার থেকে নৌকা নিয়ে এসেছেন বেপারিরা। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরুত্ব বজায় রেখে নৌকার দরদাম নিয়ে ব্যস্ত দেখা গেছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের।

নৌকার কাঠামো তৈরিতে কড়ই, আম, চাম্বল, রেইন্ট্রি ও মেহগনি কাঠ ব্যবহার হয়ে থাকে। নৌকার আকার ও মানের ওপর নির্ভর করে দাম। পাঁচ হাত থেকে শুরু করে ১২ হাত নৌকা সাড়ে তিন হাজার থেকে ১২ হাজার টাকায় বিকিকিনি হচ্ছে। তবে এবার নৌকার দাম কিছুটা বেশি বলে জানান ক্রেতারা।

নৌকা কিনতে আসা আলমগীর হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানান, জেলার দৌলতপুর উপজেলার জিয়নপুর ইউনিয়নের আবুডাঙ্গা এলাকায় তার বাড়ি। নিম্নাঞ্চল হওয়ায় বর্ষা শুরুর আগেই নৌকা কিনতে এসেছেন। তবে এবার নৌকার দাম অনেক বেশি বলে জানান তিনি। বর্ষার আগেই কেন নৌকা কিনছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে না কিনলে বর্ষার সময় বেশি দামে কিনতে হবে। এ সময়ের থেকে দাম তখন আরও বেড়ে যাবে। এ জন্য আগেই দুটি নৌকা কিনেছেন তিনি।

জেলার দৌলতপুর উপজেলার চন্দ্রখোলা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রহমান নৌকা কিনতে হাটে এসেছেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদী এলাকায় আমাগো বাড়ি। বর্ষার সময় নৌকা ছাড়া চলাচল করা যায় না। নিজের নৌকা না থাকলে সেসময় কেউ নৌকা দিতে চায় না। এ জন্য নৌকা কিনতে এসেছি। 

তবে হাটে বেপারিরা নৌকার দাম বেশি চাচ্ছে। সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা চাচ্ছে। দামে বনিবনা না হওয়ায় এখনো নৌকা কিনতে পারেননি তিনি। তবে নৌকার বেপারি দাম খানিকটা কমালেই একটি নৌকা কিনে বাড়ি ফিরবেন বলে জানান তিনি।

সাভার থেকে ৫০টি নৌকা বিক্রির জন্য ঘিওরে এসেছেন বেপারি রঞ্জিত বিশ্বাস। কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৫০টির মধ্যে ৪০টি নৌকা বিক্রি করেছি। প্রতি বছর বর্ষার সময় নৌকা বিক্রি করি। সাভার থেকে নৌকা বানিয়ে এনে এই হাটে বিক্রি করি। তাতে সব খরচ বাদে কিছু লাভ থাকে। প্রতিটি নৌকা তিন থেকে আট হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। হাটে ১২ হাত নৌকা ছয় হাজার, ১১ হাত নৌকা চার হাজার এবং ১০ হাত নৌকা সাড়ে তিন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার গয়টা এলাকার বেপারি নিত্য ঢাকা পোস্টকে বেলন, গতবারের চেয়ে এবার কম নৌকা বিক্রি করলাম। ছয়টি নৌকা ২৩ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। ছয়টি নৌকা হাটে আনতে পরিবহন ভাড়া দিতে হয়েছে তিন হাজার টাকা। এ বছর নৌকা বানানোর প্রয়োজনীয় কাঠ ও লোহার দাম কিছুটা বেশি। এ কারণে নৌকার দাম গতবারের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। তাছাড়া সব খরচ বাদে আমাগো তেমন লাভ থাকে না। অন্যদিকে হাটে ক্রেতা কম থাকায় নৌকার বেচাকেনা কিছুটা কম বলে জানান তিনি।

নৌকার হাটের বিষয়ে ঘিওর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানিকগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে মিশে আছে ঘিওরের এই নৌকার হাটটি। বর্ষার আগমনী বার্তায় জেলা ও আশপাশের লোকজন ডিঙ্গি নৌকা কিনতে এই হাটে ভিড় জমায়। আমাদের তিন পুরুষের কাছে থেকে এই ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাটের কথা শুনে আসছি। মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের কাছে এই নৌকার হাটের সুনাম রয়েছে বলে জানান তিনি।

এসপি