সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবায় খুশি রোগীর স্বজনরা। সেবা সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব নেই বলে জানিয়েছেন তারা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সাধ্যের সবটুকু দিয়েই সেবা দিচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ স্টাফরা। তবে চিকিৎসার সরঞ্জাম থাকলেও নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল। ফলে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও।

সোমবার (০৫ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টায় শ্যামনগর উপজেলার ভুরুলিয়া ইউনিয়নের খানপুর গ্রাম থেকে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত মাহফুজা বেগমকে (৫৫) সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন স্বজনরা। মাহফুজা বেগম ওই গ্রামের জয়নাল কারিগরের স্ত্রী।

মাহফুজার স্বজন ইউনুচ আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, মাহফুজাকে শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখান থেকে এখানে পাঠানো হয়েছে। এখানে আসার পর জরুরি বিভাগ থেকে কাগজপত্র দেখে ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনো ঝমেলায় পড়তে হয়নি। 

করোনা আক্রান্ত আরিফুল ইসলামকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গত ২৪ জুন। ভর্তির পর থেকেই আরিফুল ইসলামকে দেখভাল করছেন বড় ভাই রবিউল ইসলাম। আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা ইউনিয়নের কুন্দুড়িয়া গ্রামের মৃত আবুল হোসেন মোড়লের ছেলে আরিফুল ইসলাম (২৮)।  

রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেডিকেলে করোনা আক্রান্ত ভাইকে আমি দেখাশোনা করছি। বাইরে থেকে শোনা যায় মেডিকেলের চিকিৎসার অবস্থা ভালো নয়, তবে ভর্তির পর ধারণা পাল্টে গেছে আমার। গত ১০ দিনে কোনো ভোগান্তি বা সমস্যার মধ্যে আমি পড়িনি। সেবার মানে আমি সন্তুষ্ট, অন্যদের কথা বলতে পারব না। মাঝে একদিন অক্সিজেনের একটু সমস্যা হয়েছিল, সেদিন কয়েকজন মারা গেছে। সমস্যার মধ্যে এটুকু আমার নজরে পড়েছে। 

তিনি বলেন, করোনা রোগীর জন্য দামি ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে সেটির কারণে হিমশিম খাচ্ছি। হাসপাতাল থেকেও কিছু ওষুধপত্র দেওয়া হচ্ছে। ১৫০০ টাকা দামের ছয়টি ইনজেকশন দিতে হয়েছে। এছাড়ও দিনে তিনটা করে ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। যার প্রতিটির মূল্য ৭১০ টাকা। ১১ হাজার ২৫০ টাকা দামের একটি ইনজেকশন দিতে হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে।

কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা শরীফ এলাকার আলমগীর হোসেনও তার স্বজনকে নিয়ে রয়েছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত তিনদিন ধরে এখানে আছি। চিকিৎসার ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট। চিকিৎসক-নার্সরা আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীকে সেবা দিচ্ছেন। চারদিনে বাইরে থেকে ১৫ হাজার টাকার মত ওষুধপত্র কিনতে হয়েছে।

এভাবে সোমবার সকাল ৯টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চত্বরে কমপক্ষে ২০-২৫ জন রোগীর স্বজনদের কাছে হাসপতালের সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা সন্তুষ্টির কথা জানান।

এদিকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট নেই। তবে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সংকট রয়েছে। বর্তমানে ২০ হাজার ইউনিট অক্সিজেন রয়েছে সেন্ট্রাল লাইনে। সেখান থেকেই অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের। 

হাসপাতালের করোনা ইউনিটের প্রধান ডা. মানস কুমার মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে ৩৮টি। তবে কার্যকর রয়েছে ২৬টি। বাকিগুলো নষ্ট পড়ে আছে। ১৫টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা প্রয়োজন। হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা না থাকায় প্রয়োজনের সময় বিকল্প উপায়ে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

গত ১৬ জুন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে থাকা ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এখানে। সোমবার সকাল পর্যন্ত এখানে করোনা আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৮০ জন রোগী। এদের মধ্যে ২০ জনের করোনা পজিটিভ। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নার্সিং সুপার ভাইজার তৌহিদা পারভীন ঢাকা পোস্টকে জানান, হাসপাতালে ১৯৬ জন নার্স রয়েছেন। ইতোমধ্যে ২৪ জন নার্স করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। করোনা আক্রান্ত ও ছুটিতে রয়েছেন সব মিলিয়ে ৫০-৬০ জন। করোনা রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন সেবা দিতে। তবুও একজন রোগীকে সেবা দিতে আমাদের চেষ্টা ও আন্তরিকতার কোনো ত্রুটি থাকে না। আমি সরকারের কাছে হাসপাতালটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক নার্স দেওয়ার দাবি করছি।  

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদা ঢাকা পোস্টকে জানান, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার পর করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৯০টি বেড ধাপে ধাপে বাড়িয়ে বর্তমানে ২৫০টি করা হয়েছে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা আরও বেশি। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল কম হওয়ায় চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ড বয়সহ সংশ্লিষ্টরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

তিনি বলেন, হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন, হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা, ২০২টি অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ করোনা চিকিৎসার যথেষ্ট সরঞ্জাম রয়েছে। হাসপাতালটিতে চালু থাকা ১৮টি ইউনিটে চিকিৎসক প্রয়োজন ৫৮ জন, কিন্তু চিকিৎসক রয়েছেন ৩১ জন। ২৭ জন চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। এছাড়াও ৫০ জন সুইপার, ৫০ জন আয়া ও ৫০ জন ওয়ার্ড বয় প্রয়োজন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

গত ৩০ জুন অক্সিজেনের অভাবে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বেশ কয়েকজন রোগী মারা যায়। এ বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদা বলেন, অক্সিজেন পর্যাপ্ত ছিল তবে প্রেশার ফল্ট করে। এ কারণে মুমূর্ষু অবস্থায় ছয়জন রোগী মারা যায়। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে। তবে কী কারণে অক্সিজেনের প্রেশার কমে গিয়েছিল? সেটি অনুসন্ধানের জন্য তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

এদিকে রোববার (০৪ জুলাই) সকাল থেকে সোমবার (০৫ জুলাই) সকাল ১০টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। সকলেই করোনা উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় ১৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৫১ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে।

আরএআর