সারাবিশ্বে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে তখন বাংলাদেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর উচ্চহার আমাদেরকে নতুন করে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব গত মে মাস থেকে আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলা শহরগুলোতে করোনা রোগী শনাক্তের পাশাপাশি উচ্চ মৃত্যুর হারও পরিলক্ষিত হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশের মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এর উপস্থিতির প্রমাণ মিলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার যে চারটি ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছে তার তিনটি বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সক্রিয়। এই ভ্যারিয়েন্টগুলো হচ্ছে, আলফা ভ্যারিয়েন্ট (উৎস: যুক্তরাজ্য), বিটা ভ্যারিয়েন্ট (উৎস: দক্ষিণ আফ্রিকা) ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (উৎস: ভারত)।

এই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর প্রভাবে ভারত যখন সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত তখন নতুন করে ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট এর উপস্থিতি দেশটিকে আরও গভীর সংকটের দিকে ধাবিত করতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টটি আরও বেশি শক্তিশালী ও সংক্রামক। করোনার এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট এর প্রভাবে ভারতে সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়েরও আশঙ্কা প্রকাশ করছে সংস্থাটির বিশেষজ্ঞরা। আর প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকেও করোনার এই ভ্যারিয়েন্ট নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার যে চারটি ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছে তার তিনটি বাংলাদেশে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সক্রিয়।

সম্প্রতি ভারতসহ বিশ্বের এগারোটি দেশে করোনাভাইরাসের এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টটি কী? কেন বিশেষজ্ঞরা এটি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত?

ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টটি (B.1.617.2.1/AY.1) ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের (B.1.617.2) মিউটেশনের ফলে উদ্ভাবিত হয়েছে। এছাড়া এই ভ্যারিয়েন্টটিতে K417 নামে একটি অতিরিক্ত মিউটেশন রয়েছে যেটি দক্ষিণ আফ্রিকায় চিহ্নিত হওয়া বিটা ভ্যারিয়েন্টেও রয়েছে। আর এই বিটা ভ্যারিয়েন্ট এর বিরুদ্ধে বাজারে প্রচলিত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাতে জানা যায় যে, করোনার এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট ফুসফুসের কোষে সহজে আটকে গিয়ে ফুসফুসকে সংক্রমিত করতে পারে এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় দ্রুত ফুসফুসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে সক্ষম। এমনকি এন্টিবডি ককটেল (মনোক্লোনাল এন্টিবডি) দিয়েও এই ভ্যারিয়েন্টকে নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হচ্ছে না।

সম্প্রতি আমেরিকাতে ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট আরেকটি মিউটেন্ট (AY.2) এর সন্ধানও পাওয়া গেছে, যদিও ভারতে এখনো এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বিশেষজ্ঞ মহলের বরাত দিয়ে প্রকাশ করে যে, করোনাভাইরাসের এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে একজন আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তেরো জন ব্যক্তি সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া প্রচলিত টিকার কার্যকারিতা এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে এই ভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

করোনার এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট ফুসফুসের কোষে সহজে আটকে গিয়ে ফুসফুসকে সংক্রমিত করতে পারে এবং অন্যান্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় দ্রুত ফুসফুসের কার্যকারিতা নষ্ট করে দিতে সক্ষম।

সম্প্রতি সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি ও উচ্চ মৃত্যু হার রাজধানী ঢাকার তুলনায় অনেক বেশি। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার সম্প্রতি কঠোর লকডাউন ঘোষণা করেছে এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ করে ঢাকাকে অন্যান্য জেলা শহরগুলো থেকে আলাদা করেছে, যেটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

ঈদ-উল-আযহা সন্নিকটে। এই সময় কোরবানির হাটগুলোতে জনসমাগম স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিশ্চিত করা না গেলে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই সরকারকে খুব সতর্কতার সাথে আগামী দিনগুলো মোকাবিলা করতে হবে।

করোনার এই ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টকে মোকাবিলার জন্য সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনা ও সহযোগিতা এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। যেহেতু এখনো দেশের অধিকাংশ জনগণকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি, তাই টিকা না পাওয়া জনসাধারণের পাশাপাশি টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিকেও বাইরে বের হওয়ার সময় প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি (ডাবল মাস্ক পরিধান, সাবান পানিতে বারবার হাত ধোয়া ও জনসমাগম এড়িয়ে চলা) মেনে চলার সুপারিশ করছি।

প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে দেশে ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্টের ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

ড. আ. স. ম. মঞ্জুর আল হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়