পাবনায় হঠাৎ করেই বেড়েছে করোনা সংক্রমণ। সংক্রমণ বাড়লেও পাবনা জেনারেল হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা না থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। প্রতিদিনই করোনা ইউনিটে ৩ থেকে ৫ জন রোগী মারা যাচ্ছেন অক্সিজেনের অভাবে।

সোমবার (০৫ জুন) দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, পাবনা জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে গাদাগাদি করে মানুষ ঘোরাঘুরি করছেন। অনেকের মুখে মাস্ক নেই। করোনা ইউনিটেও সাধারণ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। করোনা ইউনিটের প্রবেশ পথে কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখা হয়নি। অনেকে ছয় ঘণ্টায়ও ডাক্তার দেখাতে পারেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে ১০ বার ধরনা দিয়েও একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করতে পারেননি কেউ কেউ। জনবল সংকটে চিকিৎসসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদেরও।

হাসপাতালে কথা হয় সদর উপজেলার চরতারাপুর ইউনিয়নের মো. আলমগীর হোসাইনের সঙ্গে। তার মা রাশিদা বেগম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আলমগীর বলেন, রোববার (০৪ জুলাই) দুপুরে ঠান্ডা, জ্বর ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে আম্মাকে এই হাসপাতালের করোনা ইউনিটে ভর্তি করেছিলাম। শুরু থেকেই অক্সিজেনের ঘাটতি ছিল। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ১০ বার বলার পরও তারা আমার মায়ের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়নি। অথচ করোনা ইউনিটে একটি সিলিন্ডার রিজার্ভ ছিল।

তিনি বলেন, অনেক আকুতি করার পরও তারা সিলিন্ডার দেয়নি। অক্সিজেন না পাওয়ায় চোখের সামনে মায়ের মৃত্যু দেখতে হলো। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। কেবল আমার মা নন, এ সময় হাসপাতালের প্রতিটি রোগী প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন। অক্সিজেনের অভাবে আমার সামনে তিনজন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। 

তিনি আফসোস করে বলেন, অনেক আশা নিয়ে মাকে হাসপাতালে এনেছিলাম। এখানে ন্যূনতম কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। নার্সরা ঠিকমত ডিউটিতে আসছেন না।

করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আরেক রোগীর ভাই মামুন হোসেন বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। অনেক ভালো রোগীকে করোনা ইউনিটে ভর্তি করে রেখেছে। আমার বোনকে ১২ দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি করেছি। পরদিন করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিলেও এখনো ফলাফল পাইনি। 

তিনি আরও বলেন, শহরের বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ঠান্ডা ও জ্বরের রোগীদের জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নিয়ে ভর্তি করাচ্ছে একটি দালাল চক্র। যার কারণে সাধারণ করোনা রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। 

করোনা আক্রান্ত রোগীর স্বজন সাইফুল ইসলাম ও আব্দুল হামিদ জানান, ‘রোগী ভর্তির পর হাসপাতালের ডাক্তাররাই বলছেন, এখানে অক্সিজেন নেই। রোগীর চিকিৎসা করাতে চাইলে বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে আনুন, না হলে রোগীকে রাজশাহী বা ঢাকায় নিন।’

অক্সিজেন সংকটে চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে দাবি করেন তারা।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া রিমা খাতুনের স্বামী শাহীন আলম বলেন, করোনা আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছিলাম। হাসপাতালে আনার ৪ ঘণ্টা পরও কোনো ডাক্তার আসেননি। শেষে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই আমার স্ত্রী মারা গেল।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে একটি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা অক্সিজেন দেওয়া হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। তবে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট না হওয়ায় সেটি কোনো কাজে আসেনি। বর্তমানে ২০৬টি ছোট বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও ৯১টি অকেজো। ১১৫টি দিয়ে কোনো মতে চিকিৎসা চালু রেখেছে কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারের গাফিলতিতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। 

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্বে থাকা একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রোববার সকাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট চারজন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে অক্সিজেনের ঘাটতি  থাকায় ঠিকমত অক্সিজেন সরবরাহ করতে না পারায় তিন রোগীর মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে আরও একজনের মৃত্যু হয়। এখানে করোনা রোগীদের জন্য অক্সিজেন ব্যবস্থা থাকা দরকার। হাসপাতালের সিনিয়ররা ঠিকমতো এ ওয়ার্ড দেখভাল করেন না। এমনকি নিয়মিত চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য আমাদেরকে উৎসাহও দেয় না কর্তৃপক্ষ।

২৫০ শয্যা বিশিষ্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক ডা. সালেহ মোহাম্মদ আলী বলেন, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণে ধীরগতির কারণে এখনো সেটি চালু করা যায়নি। অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। তবে করোনা রোগীর জন্য অক্সিজেনের সংকট আছে। সে কারণে প্রাথমিকভাবে আমরা ‘মিনি ফল্ট’ ব্যবস্থা দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করব। যেখানে বড় সিলিন্ডার থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হবে রোগীদের। আজ থেকে অস্থায়ী হাইফ্লো অক্সিজেন চালু হয়েছে বলে জানান তিনি।

পাবনার সিভিল সার্জন ডা. মনিসর চৌধুরী জানান, সীমান্তবর্তী জেলাগুলো থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। পাবনা জেলায়ও এ কারণেই করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে মানুষ সচেতন না হওয়াটাও একটা বড় কারণ। বারবার বলার পরও মানুষ সচেতন হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সবাই উদাসীন। 

সিভিল সার্জন বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের খুব বেশি দরকার পাবনা জেনারেল হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা। কিন্তু সেটি দ্রুত চালুর কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শুধু সিলিন্ডার দিয়ে সিরিয়াস করোনা রোগীদের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব নয়। জেনারেল হাসপাতালে যে অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে তা দিয়ে করোনা আক্রান্ত রোগীর মধ্যে যাদের শ্বাসকষ্ট কম কেবল তাদের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। 

পিসিআর ল্যাবের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিসিআর ল্যাবের অনুমোদন হয়েছে। আশা করি অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তা স্থাপন করা হবে। 

আরএআর/জেএস