প্রাণঘাতী করোনার বিস্তার রোধে চলছে সরকারঘোষিত সর্বাত্মক লকডাউন। বিধিনিষেধের কারণে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মানুষের চলাফেরা। বন্ধ রাখা হয়েছে গণপরিবহন। সড়ক থেকে হাটে-বাজারে সবখানে জনসমাগম ঠেকাতে তৎপর প্রশাসন। এ পরিস্থিতিতে হাঁড়িভাঙা আম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন রংপুরের আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা।

পহেলা জুলাই থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শুরুর পর হঠাৎ স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হাঁড়িভাঙার দর তিতে হতে থাকে। যানবাহনের চলাচল বন্ধ থাকার প্রভাব পড়ে জেলার পাইকারি হাট-বাজারগুলোতে। কমতে থাকে ক্রেতা ও পাইকারদের আনাগোনা।

এতে আমের ন্যায্য দাম নিয়ে শঙ্কায় আছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকের দাবি, আমের বাজারে ধস নেমেছে। বিক্রি কমে যাওয়াতে গাছেই পচে যাচ্ছে সুমিষ্ট এই আম।

আশংকা করা হচ্ছে, এ বছর ক্ষতি দাঁড়াতে পারে শতকোটি টাকার ওপর। তবে কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, অনলাইনে সাড়া থাকলেও কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা আসতে পারছেন না। এ কারণে লোকসানের আশঙ্কা করছেন আমচাষিরা। তবে পরিবহন ও বিপণন ব্যবস্থায় যাতে প্রভাব না পড়ে, এ জন্য তদারকি বাড়ানো হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জেলার বৃহৎ আমেরহাট মিঠাপুকুরের পদাগঞ্জ ছাড়াও নগরীর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, লালবাগ ও সিটি বাজারসহ হাঁড়িভাঙার বিভিন্ন আড়তগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। তবে কাঙ্ক্ষিত দাম মিলছে না বলে অভিযোগ আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের।

আমচাষিরা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে ভ্যান বা অন্য বাহনে করে আম নিয়ে এসে বিক্রি করছেন পাইকারি দরে। কেউবা আবার বাগানের কাছে রাস্তার ধারে আমের ক্যারেট সাজিয়ে বসে আছেন পাইকারদের আশায়। তবে পদাগঞ্জ হাটের কাদাটে পিচ্ছিল পথ ও নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভাব পড়েছে আমের বাজারে।

পদাগঞ্জ হাটে যেতে বাড়ির পাশে রাস্তার ধারে বসে থাকা আজিজুল ইসলামের সঙ্গে কথা হয়। তার চার বিঘা জমিতে রয়েছে হাঁড়িভাঙার বাগান। কিন্তু পাইকার না পাওয়ায় এবার নিজেই বাগান থেকে আম পেরে ক্যারেটে ভরিয়ে হাটে-বাজারে বিক্রি করছেন।

এই আমচাষি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এবার খুবই ক্ষতিগ্রস্ত। গত বছর যেখানে দেড় লাখ টাকার আম বিক্রি করেছি। এবার ষাট থেকে সত্তর হাজার টাকা বিক্রি করা লাগছে।’

এবার বেশি ফলন হলেও করোনার থাবায় নাস্তানুবাদ পরিস্থিতি আমের বাজারে প্রভাব ফেলেছে বলে দাবি আমচাষি আতাউর রহমানের। লকডাউনের কারণে গতবারের মতো এবারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আবহাওয়া ও পরিবহন ব্যবস্থা সচল থাকলে লোকসানের হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাবার আশা দেখছেন এই আমচাষি।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘লকডাউন তুলে নিলে আমরা ভালো দামে আম বিক্রি করতে পারতাম। লকডাউনের কারণে বাইরে থেকে পাইকাররা আসছে না। এ জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত।’

ভ্যানে করে থরে থরে ক্যারেট ভরে আম নিয়ে আসা মোহাম্মদ ইউনুছ নামে এক আম ব্যবসায়ী বলেন, ‘লকডাউনের কারণে ভীষণ সমস্যায় আছি। হাটে বাইরের পাইকার কম। আগের মতো পাইকার নেই। দামও কম যাচ্ছে। লকডাউন না থাকলে পুষিয়ে নেওয়া যেত। বাইর থেকে আমের পাইকার ও ব্যবসায়ীরা আসতে পারত, আমাদেরও উপকার হতো।’

তিনি বলেন, বর্তমানে আমের মণ ১ হাজার থেকে শুরু হয়ে সর্বোচ্চ ২৪০০ টাকা পর্যন্ত যাচ্ছে। তবে লকডাউন শুরুর দিকে দাম কম ছিল। দুই-তিন দিন থেকে মণ প্রতি বাজারে ১৫০/৩০০ টাকা বেশি বিক্রি হচ্ছে। এ রকম বাজার থাকলে একটু হলেও লোকসান কম হবে।

পদাগঞ্জ হাটে আম কিনতে আসা ওসমান গণি নামে এক পাইকারের সঙ্গে কথা হয়। তিনি কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার সড়ককাটা জয়মনিরহাট এলাকা থেকে এসেছেন। ঢাকা পোস্টকে এই পাইকার বলেন, ‘হাটে আম কিনতে কোনো সমস্যা নেই। তবে বাহির থেকে খালি গাড়ি নিয়ে আসার সময়ে পুলিশ ঝামেলা করে। কখনো মামলা দেয়, জরিমানা করে। এ কারণে অনেক পাইকার হাটে আসছে না।’

হাটে দেখা গেছে, গেল কয়েক বছরের মতো এবার দূর-দূরান্তের পাইকার কম হলেও জেলার আশপাশের পাইকার ও ব্যবসায়ীদের উপস্থিতি লক্ষ্য করার মতো। দর কষাকষি করে মণে মণে আম কিনে কেউ কেউ নিজস্ব পরিবহনে, আবার অনেকে ট্রাকে-পিকআপ ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেকই আবার কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ক্রয় করা আম বাইরে পাঠাচ্ছেন।

মেট্রো এক্সপ্রেস কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি মেহেদী হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘প্রতিদিন এক থেকে দুই ট্রাক আম বুকিং হচ্ছে। ঢাকার ভেতরে প্রতি কেজি আম ৮ টাকা, এবং ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ১২ টাকা করে খরচ নেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন ভালো ব্যবসা হচ্ছে। পদাগঞ্জ হাট ছাড়াও রংপুর নগরীর টার্মিনাল, লালবাগসহ বিভিন্ন আড়ত ও বাজার থেকেও আম বুকিং হয়।’

ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে পদাগঞ্জ হাটের মাঠটি  নাজুক অবস্থায় রয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেও কাঁদায় একাকার হয়ে যায়। এত বড় হাটে কোনো শেড না থাকায় ব্যবসার পরিবেশ নেই। যে যেখানে পাচ্ছেন, আমের পসরা সাজিয়ে বসছেন।

রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, এবার মিঠাপুকুর উপজেলার আখিরাহাট, পদগঞ্জ, মাঠেরহাট, বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুরসহ বেশ কিছু এলাকাতে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে সব জাতের আমের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে জেলায় হাড়িভাঙা আমের ফলন ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টন। যার আনুমানিক মূল্য ২০০ কোটি টাকার ওপর।

রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানালেন, আমচাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিবহনে সহায়তা করা হচ্ছে। আম ব্যবসায়ীসহ খুচরা ও পাইকাররা কোনো বাধা ছাড়াই পরিবহন সুবিধা পাচ্ছে। আমরা লকডাউনে আমসহ কৃষিপণ্যের পরিবহন স্বাভাবিক রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বলেছি।

এমএসআর