কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বড়ভিটা ইউনিয়নের নওদাবস গ্রামের বাসিন্দা রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র রায়, সুবল চন্দ্র মোহন্ত। সহজ-সরল দিনমজুর ও খেটে খাওয়া এসব কৃষকের জীবন চলে দারিদ্র্যের চরম কশাঘাতে। তাদের কাছে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হন স্বপন নামে এক ব্যক্তি। অভাব ঘোচাতে তাদের সরকারি সহায়তা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন স্বপন। বলেন সহায়তা আসবে ব্যাংকে, তাই সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। 

স্বপনের কথায় রাজি হয়ে যান রনজিৎ কুমার আর প্রভাস চন্দ্ররা। নিজের নামটুকুও লিখতে না পারা এসব কৃষকের নামে সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) শাখায় খোলা হয় সঞ্চয়ী হিসাব।

এরপর কাগজপত্র স্বাক্ষর করতে হবে বলে তাদের পাঁচজনকে ঢাকায় নিয়ে যান স্বপন। সেখানে অনেক কাগজে সই নিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠান। 

কিছুদিনের মধ্যে রণজিৎ কুমারের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রবাস চন্দ্র রায়ের হিসাব নম্বরে ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা, সুবল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ফুলমণি রানির হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা জমা হয়।

তবে এত টাকা জমা হওয়ার খবর ওই কৃষকরা পাননি। গাড়ি ভাড়ার টাকা ছাড়া তেমন কোনো অর্থ সহায়তাও স্বপন মিয়া তাদের দেননি। সরকারি সহায়তা পাওয়ার আশায় তারা দিন গুনছেন।

জানা গেছে, গত ১ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের একটি ভুয়া অ্যাডভাইস দাখিলের মাধ্যমে জালিয়াতি করে সোনালী ব্যাংক থেকে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা তুলে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগে ৯ জনের নামে মামলা হয়েছে। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় মামলাটি করেন সোনালী ব্যাংক শ্রীপুর থানা হেডকোয়ার্টার শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল হক। সেই মামলায় ৯ জনের মধ্যে পাঁচজন হলেন রণজিৎ কুমার, প্রবাস চন্দ্র, কমল চন্দ্র, ফুলমণি রানী ও সুবল চন্দ্র দাস।

এ মামলায় অভিযুক্ত অন্য ব্যক্তিরা হলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ, অফিসের অডিটর আরিফুর রহমান, মাস্টাররোলে কর্মরত তানভীর ও ঢাকার উত্তরখান জামতলা এলাকার শাহেনা আক্তার।

গত ২ জুলাই দুপুরের দিকে সবার বাড়িতে হাজির ‍পুলিশ! কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রণজিৎ কুমার, প্রভাস চন্দ্র রায়, কমল চন্দ্র রায়, ফুলমণি রানিকে নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। তবে সুবল চন্দ্র মোহন্ত এখন পর্যন্ত পলাতক রয়েছেন।

ভারতী রানী

বিষয়টির খোঁজ নিতে ৫ কৃষকের বাড়িতে যায় ঢাকা পোস্ট। এই প্রতিনিধি যখন তাদের বাড়িতে হাজির হয় তখন এসব পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চলছে কান্না আর আহাজারি। ছোট ছেলে-মেয়েদের কেউ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কেউ কাঁদছে অঝোরধারায়। 

স্ত্রী ভারতী রানী ও ২ শিশু সন্তান নিয়ে রণজিৎ কুমারের অভাব-অনটনের সংসার। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মলিন একটি কাপড় পরে আছেন ভারতী রানী। দুই মেয়ে তাকিয়ে আছে অবাক দৃষ্টিতে। পাঁচ শতক জমিতে একটি ভাঙা টিনশেড ঘরে কোনোরকম বসবাস করে আসছেন তারা। 

দিনমজুর প্রভাস চন্দ্রের স্ত্রীর নাম অঞ্জলি রানী। তাদের দুই মেয়ে, এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে, আরেকজন দশম শ্রেণিতে পড়ে। মাত্র এক শতক জমিতে একটি জরাজীর্ণ ঘরে থাকে তারা। নেই কোনো চাষের জমিজমা। প্রভাসের এক দিন কাজ বন্ধ থাকলে সংসার চালানো মুশকিল হয়ে পড়ে।

কমল চন্দ্র রায়ের বাড়িতে গিয়েও দেখা গেছে, মাত্র এক শতক জমিতে স্ত্রী মৌমিতা ও এক মেয়ে কণাকে (৮) নিয়ে জরাজীর্ণ একটি ঘরে বসবাস করেন তারা। কমল চন্দ্রও বিভিন্ন এনজিও থেকে লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কিস্তির বোঝা টানছেন। প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার টাকা কিস্তি দিতে গিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা হয় তার। অন্যের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ করে কোনো রকম দিনাতিপাত করেন।

ফুলমণি রানীর স্বামী দুই-তিন বছর আগে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা গেছেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাদের নিয়ে দুঃখের সংসার চলে কষ্টেসৃষ্টে। তারও কোনো জমিজমা নেই, বাড়ির ভিটেটুকু ছাড়া। তিনিও অন্যের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়ের খরচ ও সংসারের ব্যয় বহন করেন। 

সুবল চন্দ্র মোহন্তের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, দিনমজুরির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার। কোনো জমানো টাকাপয়সা নেই, জমিজমাও নেই। অন্যের জমিতে কাজ করা সুবলও এক দিন কাজ না করলে সংসার চালাতে পারেন না।

গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার জানান, কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার স্বপন নামের এক ব্যক্তি সরকারি প্রণোদনার দেড় লাখ টাকা পাইয়ে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। ওই ব্যক্তির কথায় দরিদ্র এসব মানুষ নাগেশ্বরী সোনালী ব্যাংক শাখায় হিসাব নম্বর খোলেন। 

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও এলাকাবাসী জানান, আটককৃতরা নিজের নামটাও ঠিকমতো লিখতে পারেন না। তারা কোনোভাবেই কোটি টাকার এই জালিয়াতি করতে পারেন না। মূল দায়ী ব্যক্তিদের ধরে অসহায় কৃষকদের মুক্তির দাবি জানান তারা।

মৌমিতা রানী

জালিয়াতি মামলার আসামি ফুলমণি রানীর ছেলে সোহেল চন্দ্র দাস বলেন, ভূরুঙ্গামারী উপজেলার স্বপন নামের ওই লোকটি আমার মাসহ আরও চারজনকে এসে বলেছেন, ‘আপনাদের সরকারি সহায়তা করা হবে। টাকা পাইতে হলে আপনারা সোনালী ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলেন।’ তার কথা অনুযায়ী আমরা অ্যাকাউন্ট খুলি। পরে আমার মাসহ আরও চারজনকে কাগজপত্র স্বাক্ষর করার জন্য ঢাকায় নিয়ে যান। এখন পুলিশ এসে আমার মাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি আমার নিরপরাধ মায়ের মুক্তি চাই। 

পুলিশ যাদের ধরে নিয়ে গেছে, তারা গ্রামে সবচেয়ে দরিদ্র ও নিরীহ মানুষ। তারা অসহায় মানুষ। তাদের পক্ষে এত বড় অপরাধ করা সম্ভব নয়। তাদের অনুদান দেওয়ার কথা বলে ব্যবহার করেছে চক্রটি। বর্তমানে তাদের পরিবারগুলো খুব কষ্টে আছে। খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে সারাদিন শুধু কাঁদছে।

আরেক অঅসামি রনজিতের স্ত্রী ভারতী রানী বলেন, আমাদের সাহায্য দেওয়ার কথা বলে এভাবে ফাঁসাইল? আমরা তো এত কিছু বুঝিনি। আমার স্বামী নিজের নামও লিখতে পারেন না। আমার স্বামীর মতো সরল লোক গ্রামে নাই। এক দিন কাজ না করলে পেটে ভাত যায় না আমাদের। এখন আমি ছেলে-মেয়েদের কী খাওয়াব? আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর বিচার চাই

বড়ভিটা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. খয়বর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মনে করি না তারা এ রকম কাজ কোনো দিনও করতে পারে। সরকারের কাছে আবেদন, আসল প্রতারক চক্রটিকে ধরে আইনের আওতায় আনা হোক। আর সহজ-সরল এই মানুষগুলোকে মুক্তি দেওয়া হোক।

ফুলবাড়ী থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) সারোয়ার পারভেজ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, গাজীপুরের শ্রীপুর থানা পুলিশ আমাদের সহযোগিতায় পাঁচ আসামিকে আটক করে নিয়ে গেছে। যেহেতু মামলাটি শ্রীপুর থানায় হয়েছে, সবকিছু ওখানেই হবে। 

সোনালী ব্যাংকের নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) শাখার ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) উত্তম কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, কৃষকরা টাকা পাওয়ার আশায় ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। তবে তারা টাকা উত্তোলন করতে ব্যাংকে আসেননি। ব্যাংকে যারা চেকগুলো নিয়ে এসেছিল, তাদের দেখে আমাদের সন্দেহ হলে আমরা গাজীপুরের শ্রীপুর শাখায় যোগাযোগ করে টাকা উত্তোলন বন্ধ করে দিই। 

মামলার এজাহারে কী ছিল?

এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ জুন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসারের স্বাক্ষরকৃত অ্যাডভাইসের মাধ্যমে ৫টি বিল পরিশোধের (সরকারি চাকরিজীবীর আনুতোষিক) জন্য মোট ২ কোটি ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ টাকা প্রদানের নিমিত্তে অভিযুক্ত কর্মচারী তানভীর অ্যাডভাইসের হার্ডকপি ব্যাংকে নিয়ে আসেন।

মোটা অংকের টাকা হওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী এ সময় ব্যাংক থেকে হিসাবরক্ষণ অফিসে ফোন করার পর অভিযুক্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ এসব অ্যাডভাইসের নিশ্চয়তা দেন। অ্যাডভাইস অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী কুড়িগ্রাম শাখায় অভিযুক্ত রনজিত কুমারের সঞ্চয়ী হিসাবে ৪৮ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ টাকা, প্রবাশ চন্দ্র রায়ের হিসাব নম্বরে ৬৫ লাখ ৭২ হাজার ১২০ টাকা পাঠানো হয়।

এছাড়া সুবল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪০ লাখ ৭১ হাজার ৭২০ টাকা, কমল চন্দ্রের হিসাব নম্বরে ৪২ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮০ টাকা, ফুলমনি রাণীর হিসাব নম্বরে ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৫২০ টাকা প্রদান করা হয়।

পরদিন ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ তৈরি হলে তারা নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) সোনালী ব্যাংকের শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করে হিসাব নম্বরগুলো যাচাই করেন।

এতে জানা যায়, হিসাবধারীরা সরকারি চাকরিজীবি নন তারা প্রত্যেকেই কৃষক। পরে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে অধিকতর খোঁজ নিলে জুনিয়র অডিটর খলিল উদ্দিন ‘এ বিলে ঝামেলা রয়েছে’ বলে জানান। পরে জালিয়াত চক্রের এমন কাণ্ডে দ্রুত নো পেমেন্টের জন্য সোনালী ব্যাংক নাগেশ্বরী শাখাকে বলা হয়।

এরপর অভিযুক্ত শাহেনা আক্তার সোনালী ব্যাংক উত্তরখান শাখা থেকে উক্ত টাকাগুলো উত্তোলনের লক্ষে নাগেশ্বরী শাখার চেকগুলো জমা দেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের চতুরতায় শেষ পর্যন্ত সরকারি টাকা হাতিয়ে নিতে পারেনি জালিয়াত চক্র।

এ ঘটনা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় ২৯ জুন অভিযুক্ত হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বজলুর রশিদ বিলটি স্থগিত রাখার জন্য পত্র প্রেরণ করেন। যদিও তিনি প্রথমে এ বিল ছাড় করার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের বলেছিলেন।

এনএ/জেএস