ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালী গ্রামের ফুলচাষি সুমন বিশ্বাস। দুই বিঘা জমিতে গোলাপ আর দুই বিঘা জমিতে জারবেরা চাষ করেছিলেন। প্রতি মাসে গড়ে ৭০ থেকে লক্ষাধিক টাকার ফুল বিক্রি করতেন তিনি। গত বছর করোনার প্রকোপের সময় মোটেও ফুল বিক্রি করতে পারেননি তিনি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তার দুই বিঘার জমির জারবেরা পলিশেড উড়ে যায়।

এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে শেডটি মেরামত করেন। গত বছরের আগস্ট থেকে ঘুরে দাঁড়ায় ফুলের বাজার। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন সুমন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। লাগাতার লকডাউন-বিধিনিষেধে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে জমিতে ফোটা ফুল। স্থানীয় বাজারে ফুলের বেচাকেনা ও চাহিদা না থাকায় বাধ্য হয়ে গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সাইকেল চালিয়ে যশোর শহরে পানির দরে ফেরি করে ফুল বিক্রি করছেন সুমন বিশ্বাস।

সুমন বিশ্বাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, চার লাখ টাকা বিনিয়োগ করে চার বিঘা জমিতে গোলাপ ও জারবেরা চাষ করেছি। সেই জমিতে মাত্র দুই লাখ টাকার মতো ফুল বিক্রি করতে পেরেছি। আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলে দিয়েছে। গতবার করোনা ও আম্পান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এবার ক্ষতি পোষাতে এ টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু লোকসানে এখন সর্বস্বান্ত। বিকল্প আবাদেও যেতে পারছি না।

তিনি বলেন, করোনার আগে সারা বছরই ফুল বেচাকেনা হতো। জমি থেকে ফুল কেটে গদখালী বাজারে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যেত। আবার জাতীয় দিবসগুলোর সময় বাজারে ফুল নেওয়া লাগত না, জমিতেই থাকতেই পাইকাররা ফুল কিনে নিতেন। এখন তো ফুল কেউ দেখতেও আসে না। না পারছি হাত পাততে, না পারছি মজুরির কাজ করতে। তাই এত দূর সাইকেল চালিয়ে এসে বিক্রি করছি ফুল। তাও কেউ কিনছে না। বরং হাসছে!

শুধু সুমন নন, ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিত যশোরের গদখালী এলাকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ফুলচাষি জমির ফুল শহর ও গ্রামে সাইকেল বা ভ্যানে ফেরি করে বিক্রি করছেন। আবার অনেকেই সেটা না করতে পারায় ক্ষেতের ফুল কেটে গরু-ছাগলের খাদ্য হিসেবে জোগান দিচ্ছেন।

সংশ্লিষ্ট ফুলচাষি-ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর ৩০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয় দেশে। করোনার কারণে গত বছরের পাঁচ মাস আর চলতি বছরের তিন মাসে ফুল বিক্রির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সরকারের সহায়তা চেয়ে দুই বছরের স্বল্প সুদে ঋণ চেয়েছেন এ খাতের সবাই।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সূত্রমতে, যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছার পানিসারা-গদখালী গ্রামগুলোর রাস্তার দুই পাশে দিগন্তবিস্তৃত জমিতে সারা বছরই লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার হয়ে থাকে। শত শত হেক্টর জমি নিয়ে গাঁদা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হয় এখানে। এলাকায় উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য গদখালীতে যশোর রোডের দুই ধারে রয়েছে ফুলের বাজার।

প্রতিদিন উপজেলার গদখালী-পানিসারার শত শত ফুলচাষির আনাগোনা শুরু হয় গদখালীর বাজারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররাও সেখান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যান। বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে এই ফুল ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। তবে করোনার কারণে ছেদ পড়েছে গদখালী-ব্যবসায়ীসহ এ খাতের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে প্রায় ২০ হাজার ফুলচাষি রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু যশোর জেলায় প্রায় ছয় হাজার চাষি সার্বিক চাহিদার সিংহভাগ সরবরাহ করে থাকে। এ জন্য যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ফুলের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই অঞ্চলের কৃষকের প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে ফুলই স্বীকৃত। সেই ফুলের রাজধানীতে চাষিরা ভালো নেই। মহামারি ও ঘূর্ণিঝড়ের ধকলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

আরও জানা গেছে, গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দেশের করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সামাজিক অনুষ্ঠান ঘিরে ফুলের চাহিদা বাড়ে। বেচাকেনাও মোটামুটি ভালো ছিল। তখন চাষিরা ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু মার্চ থেকে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে কয়েক দফায় লকডাউন বিধিনিষেধ ফুলের বাজারে ধস নামে।

১৯৮২ সালে ছোট্ট একটি নার্সারির মাধ্যমে ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা এলাকায় প্রথম ফুলের চাষ শুরু করেন শের আলী সরদার। যশোরের গদখালী যে ফুলের রাজধানী, তার পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত তিনি। কিন্তু বর্তমান দুর্দশা দেখতে চান না বলে তিনি এখন ফুলের জমিতেই যান না।

শের আলী সরদার বলেন, গত বছর করোনা ও আম্পানের পর চাষিরা নিজ উদ্যোগে আবার ফুল চাষ শুরু করেছিলাম। এর মধ্যে আবার লকডাউনে সব শেষ। ৪২ বছরের ফুল চাষের জীবনে এমন ঘটনা আমি আগে কখনো দেখিনি। গদখালীতে ফুলের চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে এখন। কীভাবে আর ঘুরে দাঁড়াব, জানি না।

পানিসারা গ্রামের ফুলচাষি শফিকুল ইসলাম ঢালী বলেন, দুই বিঘা জমিতে জারবেরার চাষ করেছি। করোনার পর ফুলের ভালো দাম পেয়েছিলাম। এখন ফুল বিক্রি বন্ধ। তাই বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজারে ভ্যানে ও সাইকেলে করে ফুল বিক্রি করছি।

ফুলচাষি শমজেদ বলেন, আগে প্রতি পিস ফুল যে দামে বিক্রি করতাম, এখন ১০০ পিস বিক্রি করেও সেই দাম পাই না। বর্তমানে ১০০ গোলাপ ১০ টাকা, যা করোনার আগে প্রতিটি পিস বিক্রি করেছি দেড় থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত। ১০০ গ্লাডিওলাস ২০ টাকা, যা করোনার আগে প্রতি পিস ছিল ২০ টাকা। ১০০ ভুট্টাফুল ২০ টাকা, করোনা আগে বিক্রি করেছি প্রতি শ ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। বেচাকেনা না থাকায় খরচও ওঠে না। সংসার চালাতে তো হিমশিম খাচ্ছিই।

ফুলচাষি সালাম বলেন, চারদিকে সভা-বিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ফুল বিক্রির আর কোনো জায়গা নেই বললেই চলে। বাধ্য হয়ে শহরে বা গ্রাম অঞ্চলের বাজারে ফেরি করে বিক্রি করি। তাও কেউ কিনতে চায় না। শেষে বাড়িতে এসে গরু-ছাগলকে খাওয়াই।

যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল চাষের সঙ্গে এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন। করোনার কারণে ফুলের বাজার বন্ধ রয়েছে। খেতে ফুল নষ্ট হচ্ছে। ফুলচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের প্রণোদনা হিসেবে আউশ ধানের বীজ, টমেটোর চারা দিয়েছি।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, দেশের চাহিদার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত বছরের ৫ মাস এবং চলতি বছরের ৩ মাসে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোর অঞ্চলে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০০ জন চাষিকে ২ কোটি টাকার মতো ঋণ দেওয়া হয়েছে। করোনার কারণে চাষিদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার স্বপ্নও শেষ।

তিনি বলেন, ফুলচাষিদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। উৎপাদন ধরে রাখতে চাষিরা ক্ষেতের ফুল গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুমতি ও একই সঙ্গে ফুলচাষিদের প্রণোদনা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান এই কৃষকনেতা।

এনএ