একসময় হাতে ছিল ডাস্টার-মার্কার, এখন রিকশা-ভ্যান
তিন মাস ধরে সন্তানের দুধের ব্যবস্থা করতে পারেননি অসহায় বাবা। তাই সন্তানের মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে দিনের বেলা বাড়িতেও থাকেন না তিনি। সন্তানরা যখন ঘুমিয়ে পড়েন, তখন বাড়ি ফেরেন। অথচ স্ত্রী-সন্তান সবাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
দেড় বছরে দুই ঈদে সন্তানদের একটা নতুন কাপড়ও কিনে দিতে পারেননি। এ যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত পোড়াচ্ছে শহিদুল ইসলামকে। করোনাকালে সংসারের টানাপোড়েন কী জিনিস, তা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই শিক্ষক।
রংপুর নগরীর মাহিগঞ্জ আমতলা বিদ্যাপীঠের শিক্ষক শহিদুল ইসলাম। এই বিদ্যাপীঠে প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। সেখানে ১০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। সামান্য বেতন আর টিউশনে যা আয় হতো, তাই দিয়ে কোনোমতো সংসার চালাতেন।
বিজ্ঞাপন
কিন্তু প্রাণঘাতী করোনার প্রাদুর্ভাবে তার জীবনে এসেছে ছন্দপতন। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধসহ বেতন সুবিধা না থাকায় অবর্ণনীয় কষ্ট তার পিছু নিয়েছে। এখন অর্ধাহার-অনাহারে দিনের পর দিন মানবেতর দিন কাটছে তার।
শিক্ষক শহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মহামারি শুরুর পর থেকে স্কুল বন্ধ। প্রায় দুই বছর হতে চলেছে। কিন্তু সংসার পেট তো বন্ধ নেই। শিক্ষকতা পেশার কারণে সমস্যায় পড়ে আছি। এই পেশা আজ আমার মতো অনেকের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়ছে। না পারছি অটো বা রিকশা চালাতে, শ্রমিকের কাজও করতে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। অন্য কোনো কর্মের সুযোগও পাচ্ছি না।’
বিজ্ঞাপন
শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকতা করে শুধু সালাম-সম্মান পাওয়া যায়। মনের ভেতরে পুষে রাখা দুঃখ-কষ্টের কথা কেউ জানে না। আমার মতো অনেক শিক্ষক রয়েছেন। যারা সংসারের অভাব অনটনের কারণে চলতে পারছেন না। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকেরা জাতির কাছে এখন বোঝা হয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থ-সামর্থ্য থাকলে, আমরা অন্য কিছু করতাম। কিন্তু আমার মতো অনেকের সামার্থ্য নেই। এখন আমরা কোথায় যাব, কে আমাদের দেখবে? কতদিন এভাবে চলতে হবে। এ প্রশ্নের উত্তর আমি কি সন্তানকে দিতে পারব?’
শহিদুল পেশা বদলের সুযোগ না পেলেও তানজুল ইসলাম নিজের পেশা বদলে নিয়েছেন। একসময় ক্লাস রুমে ডাস্টার, মার্কার হাতে পাঠদানে ব্যস্ত এই শিক্ষক এখন অটোরিকশার চালক। পেট বাঁচানোর যুদ্ধে ঠিকে থাকতে নিজের গড়া তাওহীদা কিন্ডারগার্টেনের পথ ভুলে গেছেন। এখন অটোরিকশা নিয়ে শহরের পথে পথে ছুটছেন তিনি।
তানজুল ইসলাম যে স্কুলে পাঠদান করাতেন, তা রংপুর নগরের আট নম্বর ওয়ার্ডের কিশামত কার্তিক হাজীরবাজার এলাকায়। তার পরিচালিত তাওহীদা কিন্ডারগার্টেনে প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থী ছিল। সেখানে তার ছোটভাই তৈয়বুর রহমানও শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু করোনার কারণে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পেশা বদলে বাধ্য হয়েছেন তিনিও। যে স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসেছিলেন, সেই স্বপ্ন যেন তাদের আজ অধরা।
করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়। তানজুল ও তৈয়বুর হয়ে পড়েন বেকার। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গোছানো পরিবারে দেখা দেয় আর্থিক সংকট। কয়েক মাস বেকার থাকার পর তৈয়বুর কাজের সন্ধানে চলে যায় ঢাকায়।
আর গ্রামের বাড়িতে থাকা তানজুল ইসলাম হাতে তুলে নেন অটোরিকশা। এভাবে এখন তাদের পরিবার চলছে। তবে দুই ভাইয়ের আকুতি কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের দিকেও সরকারের সুনজর পড়ুক।
অন্যদিকে শিক্ষক পরিচয় থেকে গাছ বিক্রেতা হয়ে গেছেন হযরত আলী। রংপুর নগরের সার্কিট হাউস সড়কের পাশে কটকিপাড়া এলাকায় গড়ে তুলেছেন রিসালাত ছাদবাগান নামের একটি নার্সারি।
তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৫ সালে নগরের রামপুরা এলাকায় ফাতাহ কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে শিক্ষার্থী ছিল প্রায় ২০০। করোনা পরিস্থিতিতে গত বছর থেকে অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তার প্রতিষ্ঠানটিতেও তালা ঝুঁলছে।
বেকার থাকার চেয়ে গাছের চারা রোপণ করে তা বিক্রির বিষয়টি তার মনে ধরে। কিন্তু মধ্যবিত্ত জীবনে স্কুলশিক্ষক থেকে গাছ বিক্রেতার পরিচয় একটু হলেও মানসিক পীড়া দেয় তাকে। পরিস্থিতি বুঝে ঝুঁকে পড়েন নার্সারি গড়ার কাজে। শুরুতে আয় তেমন হয়নি। আর্থিক সংকটে বেশি কিছুদিন হতাশায় ভুগলেও এখন মাস শেষে তার আয় ১৫ হাজার টাকা পান।
হযরত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনোরকমে সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন। মধ্যবিত্ত জীবনে টিকে থাকতে অনেক কিছুই করতে হয়। কিন্তু আমার শিক্ষকদের নিয়ে খুব কষ্ট হয়, যাদের কোনো কিছু করার অর্থ সামর্থ্য নেই। তারা অনাহারে আছেন। বাসাভাড়া দিতে পারছেন না।
তিনি আরও বলেন, সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট হয়। অতিকষ্টে জীবনযাপন করছে। দেশের কিন্ডারগার্টেনগুলোর প্রায় ৩ লাখ শিক্ষক-শিক্ষিকার অবস্থা একই। কেউ আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন-ভাতা সবই পাচ্ছেন, কিন্তু আমাদের মতো শিক্ষকদের তো বেতন নেই।
আমতলা বিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা মহামারিতে আমাদের কথা কারও মনে নেই। বিশেষ করে সরকারের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশের ৬০ হাজারের বেশি কিন্ডারগার্টেন রয়েছে, তা ভুলে গেছেন। আমরা কেমন আছি, কীভাবে আমাদের দিন যাচ্ছে, তা তাদের অজানা।
তিনি আরও বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ১৮ জন শিক্ষক। গত দেড় বছরে তাদের একটু একটু করে বেতন দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এখন আর দিতে পারছি না। তাদের দিকে তাকালে নিজেরও কষ্ট লাগে। কিন্তু আমি নিজেও তাদের মতো অসহায় ও নিরুপায়।
ঠাকুরগাঁও সদরের ছোট খোচাবাড়ি এলাকার ডোমিনো স্কুলের শিক্ষক মতিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, করোনাকালীন স্কুল বন্ধ থাকায় বেতনও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বেতন না পাওয়ার কারণে জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্ত পার করছি। গত বছরের মতো এবার ঈদেও সন্তানদের জন্য কিছুই কিনতে পারেননি। শুধু শিক্ষকতা করার কারণে অন্যের কাছে হাত বাড়ানোটা লজ্জার বলে তাদের অনেকেই দুঃখ কষ্ট সহ্য করে আছেন।
একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সবুজ দেব শর্মা ও ডালিম সরকার ঢাকা পোস্টকে জানান, করোনায় স্কুলের বেতন না থাকলেও বিভিন্নভাবে টিউশন করে সংসার চালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঠাকুরগাঁওয়ে এখন যেভাবে করোনার বিস্তার হয়েছে, তাতে কোথাও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কুড়িগ্রামের রাজারহাট কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাদশা মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই বছরের মতো হবে স্কুল বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় চরম বিপাকে আছি। স্কুল না খোলা পর্যন্ত আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তো বেতনের টাকা চাইতে পারি না। এতে করে আমরা তো নিজেরাও কষ্টে আছি। সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধরে রাখাও এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
একই উপজেলার সোনামনি কিন্ডারগার্টেনের প্রধান শিক্ষক আবু বক্কর ও শিশু নিকেতন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক ফখরুল ইসলাম জানান, প্রতিনিয়ত সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। তাদের অনেকেই স্কুলের আসবাবপত্র বিক্রি করেছেন। কেউ কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড নামিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। স্কুল বন্ধ থাকায় কেউ বেতন পাচ্ছেন না।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের শিবরাম প্রি-ক্যাডেট কিন্ডারগার্টেনের অধ্যাক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, আমরা শিক্ষার গুণগত মান রক্ষা করে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। করোনাভাইরাস এসে সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। তখন থেকে আমাদের স্কুল বন্ধ হয়ে আছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি আমরা শিক্ষকরাও অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। আমরা ঠিকমত বেতনও দিতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, আমরা যেভাবে দিন অতিবাহিত করতেছি এটাকে চলা বলা যায় না। পরিবারের ঠিকমতো খরচ দিতে পারছি না। অনেকটা দুর্বিষহ দিন অতিবাহিত করছি। তাছাড়া সরকারি কোনো অনুদানও পাইনি। এ রকম থাকলে দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা হোঁচট খেয়ে পরবে।
সহকারী শিক্ষক আবদুল হান্নান বলেন, দীর্ঘ দেড় বছর থেকে স্কুল বন্ধ আমরা কোন বেতন পাচ্ছি না। করুণ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। সামনে ঈদ আসছে ছেলে-মেয়েদের নতুন পোশাক দিতে পারছি না। বাবা মায়ের ওষুধ কিনতে পারছি না। আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছি। আমাদের সংসারে অচল অবস্থা বিরাজমান।
নর্থবেঙ্গল কিন্ডারগার্টেন অ্যান্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুল সোসাইটি রংপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুরে হযরত, তানজুলের মতো অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। আমরা তো কারও কাছ থেকে মানবিক সহায়তাও পাচ্ছি না। অনেক শিক্ষক ভ্যানে করে শাক-সবজি, ফলমূল বিক্রি করেছেন।
তিনি আরও বলেন, কেউ কেউ দোকানে, পার্লারে কাজ নিয়েছেন। একটু ভালো থাকার জন্য এছাড়া আমাদের উপায় নেই। কিন্তু সরকারের উচিত আমাদের জন্যেও কিছু করা। আমরা তো দেশের নাগরিক, তাহলে আমরা কেন সরকারের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত?
সংগঠনটির সভাপতি গোলাম সাজ্জাদ হায়দার ঢাকা পোস্টকে জানান, রংপুর জেলায় প্রায় ৭০০ কিন্ডারগার্টেন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সাড়ে ৮ হাজারের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত ছিলেন। করোনাকালে তাদের বেশির ভাগ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহায়তা বা প্রণোদনা পাননি তারা।
এমএসআর