অর্ধশতাধিক পরিবার জানে না কোথায় গন্তব্য
অসুস্থ চা দোকানি স্বামীর সামান্য উপার্জনে সংসার চালাতেন যশোর শহরের ভৈরবতীর বিশিষ্ট পুরাতন কসবা ঘোষপাড়া এলাকার নার্গিস বেগম। সেখানে আধা পাকা দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘরে স্বামী-সন্তান নিয়েই তার বসবাস। নিত্য অভাব-অনটনের মধ্যে দিন চললেও নিজেদের ভিটেমাটিতেই পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ নার্গিস দেখেন, এত কিছু থাকার পরও কিছুই নেই আর।
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদী খননের নামে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। আর এতেই ধসে গেছে নার্গিসের বাড়ি-ঘর। শুধু বাড়ি-ঘর ধসের মধ্য দিয়েই শেষ হয়নি। প্রতিদিন নদীতে পানি বাড়ায় স্রোতে নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে নার্গিস বেগমের ভিটামাটিসহ আরও অনেকের ঘর-বাড়ি।
বিজ্ঞাপন
শুষ্ক মৌসুমে তারা যে ভিটেমাটিতে ফিরে আবারও ঘর তুলবেন, সেই সুযোগটুকুও নেই। ঘরের জিনিসপত্র নিয়ে তাই বাধ্য হয়েছেন নিজভিটে ছেড়ে যেতে।
‘ভৈরব নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে অনেক দিন থেকে ভাঙন শুরু হয়েছে। হঠাৎ করেই আজ ঘরের পুঁতা ভাঙছে, কাল টিন খুলে যাচ্ছে। এভাবে পড়তে পড়তে পুরো ঘরটিই নদীতে বিলীন হয়েছে। না পেরে ভিটা ছেড়ে দিতে হলো,’ নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরে ঢাকা পোস্টকে বলেন নার্গিস বেগম।
তা ছাড়া কোথায় থাকব? কোনো উপায় নেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি অভিযোগ করেন, মাথা গোঁজার ঠাই ভেঙে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমিদস্যুরা। তার মতো একই অবস্থা এই এলাকার অনেকেরই।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, ২০১৬ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের চৌগাছার তাহেরপুর থেকে অভয়নগরের আফরাঘাট পর্যন্ত ৯৬ কিলোমিটার ভৈরব নদী খননের কাজ চলমান রয়েছে। ২৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ভৈরব রিভার বেসিন’ এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যানুযায়ী ইতোমধ্যে নদীর উজান ও ভাটির ৭০ কিলোমিটারের বেশি কাজ প্রায় শেষ। জটিলতা চলছে শহরের দড়াটানা অংশের কাজ নিয়ে। এ খননকাজ শেষ হওয়ার তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালের ২০ জুন।
দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এবং তৃতীয় দফায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ভৈরব নদী খননের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু যশোরে নদী খননের নামে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। বালু উঠিয়ে জমা করা হচ্ছে নদীর দুই পাড়সহ কৃষিজমিতে। আর কৃষিজমিতে বালু রাখায় ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদন। এতে হুমকির মুখে পড়েছে নদীপাড়ে বসবাসকারীরা।
ইতোমধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদে বিলীন হয়ে গেছে ১১টি বাড়ি। এ ছাড়া নদের পাড় ভেঙে বসতবাড়িসহ দোকানপাট নদে বিলীনের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে নদতীরবর্তী বসবাসকারী অর্ধশতাধিক পরিবার। বাধ্য হয়ে ছেড়ে যাচ্ছেন ভিটেবাড়ি।
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, বালু উত্তোলন করা হয়নি। নদীর ভেতর বানানো ঘরই কেবল ভেঙে পড়ছে।
সরেজমিনে কসবা ঘোষপাড়া এলাকায় দেখা গেছে, নদীর পাড় ভেঙে যাওয়ায় ১১টি পরিবারের বাড়ি-ঘর ধসে ভৈবর নদীতে বিলীন হয়েছে। ঘরে থাকতে না পেরে পরিবারগুলো অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার জন্য তাদের জিনিসপত্র রিকশা বা ভ্যানে তুলছেন। কেউবা ভাঙা ঘরে নিরাপদ নয় বলে পাশের রাস্তায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসে আছে। তাদের সবার চোখে-মুখে স্বপ্ন ভাঙার ছাপ। এসব পরিবারের এখন একটাই দাবি, যারা তাদের বসতবাড়ি বিলীন করে দিয়েছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর আশ্রয়ণের ব্যবস্থা করা হোক।
ভুক্তভোগী শফিয়ার রহমান শেখ জানান, পুরাতন কসবা ঘোষপাড়ায় ভৈরব নদীর ধারে তার বাড়ি। পৈতৃকভাবে কয়েক পুরুষ তারা এখানে বসবাস করছেন। পেশায় তিনি দিনমজুর। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় তার সাড়ে তিন শতক জায়গার মধ্যে দুই শতক নদীগর্ভে মিশে গেছে। বাড়ি-ঘর হারিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। মাথা গোঁজার নেই কোনো ঠাঁই। নদী থেকে যারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছে, তিনি তাদের কঠোর শাস্তির দাবি করেন। পাশাপাশি বসবাস করার জন্য আশ্রয় চান।
কয়েক যুগ ধরে নদীর পাশে পাঁচ শতক জমিতে বসবাস করে আসছেন তপু ঘোষ। তিনি জানান, অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে নদী মাত্রাতিরিক্ত গভীর হয়ে পড়েছে। কিছু মানুষের ব্যক্তিস্বার্থে এখানকার শতাধিক পরিবার চরম বিপদের মধ্যে পড়েছে। ১১টি পরিবারের ঘর-বাড়ি সব নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। তারও বাড়ি-ঘর শেষ হয়ে গেছে।
ঝর্ণা বেগম নামের এক ভুক্তভোগী জানান, প্রতিদিনই আস্তে আস্তে ভৈরব নদীর পাড় ভেঙে যাচ্ছে। আর আমাদের ঘরবাড়ি নিচে ডুবে যাচ্ছে। নদীতে পানি বাড়ার কারণে বেড়েছে নদীর স্রোত। ফলে পরিবার নিয়ে এখানে বসাবস করতে ঝুঁকিতে আছি।
ইসহাক মিয়া নামে এক বয়োজ্যেষ্ঠ ভুক্তভোগী বলেন, আমার জীবনভর এখানে বাস করে আসছি। আমার নামেই এই জমির পর্চাও রয়েছে। কিন্তু নদী কাটার নাম বলে আমাদের এখান থেকে বালু তুলেছে। নদী থেকে যেটুকু বালু তোলার কথা, তার চেয়েও বেশি তুলেছে। আবার উত্তোলিত বালু দিয়ে নদীর পাড় বাঁধার কথা ছিল, কিন্তু পাড় বাঁধেনি। বালুগুলো বিভিন্ন জায়গায় জড়ো করে রেখেছে। এই অতিরিক্ত বালু তোলার কারণে আমাদের বাড়ির নিচের মাটি সরে গেছে। এখন ঘরবাড়ি সব ভেঙে যাচ্ছে। আমরা অসহায় গরিব মানুষ। কোথায় যাব? তাই জিনিসপত্র ভ্যানে তুলে কোনো বস্তিতে চলে যাচ্ছি।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি অভিযোগ করেন, সরকার দিয়েছে নদী কাটতে। নদী না কেটে বালু তুলে লাখ লাখ টাকার বালু তুলে বিক্রি করছে। এই এলাকা বিলীন করে দিয়েছে। আমি এদের শাস্তি চাই।
ইসহাক মিয়ার মতো এলাকার হানিফ শেখ, খালেদা বেগম, আলমগীর শেখ, নাসিম শেখসহ সবাই যাদের কারণে তারা বাড়ি-ঘর হারিয়েছে, তাদের শাস্তির দাবি করেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন সরকারের কাছে।
এদিকে নদী খননের নামে বালু তোলায় এলাকাবাসীর সঙ্গে ক্ষুব্ধ যশোর সদর উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বিপুল। তিনি দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ভূমিদস্যুদের।
‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছুসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিভিন্ন অঞ্চলের যারা ভূমিদস্যুরা মিলে নদী খননের নামে বালু উত্তোলন করছে। ওই এলাকায় বাড়িঘর ধসে যায়। এসব ভুক্তভোগী দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছে। এ বিষয়ে পানি উন্নয়নের বোর্ডের সাথে আমি কথা বলেছি কিন্তু ওনি এই বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি। পরে জেলা প্রশাসককে বিষয়টি অবহিত করেছি। তবে অবৈধ বালু উত্তোলনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড,’ বলেন চেয়ারম্যান।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ডিজাইন অনুসারেই নদী খননের কাজ চলছে। তবে আমাদের ডিজাইন অনুযায়ী কিছু জায়গায় নদীর বেডেই বালু আছে; সেখানেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। বালু বা মাটি যা-ই থাকুক, সেটাই খনন করা হচ্ছে। যাদের বাড়িঘর ভেঙেছে, তারা অবৈধভাবে সেখানে বসবাস করছে। নদীর ভেতর বানানো ঘরই কেবল ভেঙে পড়ছে।
আর বালু উত্তোলন বা বিক্রির অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই কর্মকর্তা।
এনএ