করোনাভাইরাস ভয়াল রূপে দেখিয়েছে গত জুলাই মাসে। মহামারিতে এ মাসে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় ভয়াবহতা ছিল সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে সর্বাধিক মৃত্যুর রেকর্ড শনাক্তও হয়েছে। একই সঙ্গে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আর ওই মাসেই এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও শনাক্তের রেকর্ড হয়েছে।

তবে জুলাইয়ের শেষ দিকে এসে বিভাগে করোনার শনাক্ত ও মৃত্যু কমেছে। এতে সন্তুষ্ট নন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। বিভাগে এখনো সংক্রমণের হার ২৮ শতাংশ। সংক্রমণের হার ৫ শতাংশের নিচে না আসা পর্যন্ত সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না বলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. জসিম উদ্দিন হাওলাদার জানিয়েছেন।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মহামারিতে এক মাসে সর্বাধিক ১ হাজার ৩১৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে জুলাইয়ে। এক মাসে সর্বাধিক ৩৬ হাজার ১৫ জন রোগীও শনাক্ত হয়েছে ওই মাসেই। আর একই মাসে সর্বাধিক ৩০ হাজার ৩৮৫ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।

অপরদিকে গত জুন মাসে বিভাগে ৪২৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। শনাক্ত হয়েছিল ২২ হাজার ৬২৬ জন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন ৭ হাজার ৪৩ জন। দুই মাসে তিন দিক বিবেচনায় জুলাইয়ে করোনার ভয়াবহ অবস্থা ছিল খুলনা অঞ্চলে।

মহামারির ১৭ মাসে এখন পর্যন্ত খুলনা বিভাগে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা, যা গত বছরের করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর অর্ধেকের বেশি। গত বছর মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর এক দিনে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছিল শুক্রবার (৯ জুলাই)। আর ৭ জুলাই এক দিনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৯০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছিল। তবে জুলাইয়ের প্রথম তিন সপ্তাহের চেয়ে শেষ সপ্তাহে এসে সেই ভয়াবহতা কমেছে। সর্বশেষ ৩১ জুলাই বিভাগে ১৯ জনের মৃত্যু এবং শনাক্ত হয়েছে ৫৭১ জনের।

করোনার সংক্রমণরোধে সারাদেশে ১ জুলাই থেকে ১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ শুরু হয়। ১৪ দিনের বিধিনিষেধ শেষে ঈদ উপলক্ষে ৫ দিনের জন্য বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। ঈদ উপলক্ষে মানুষের এক শহর থেকে আরেক শহরে যাতায়াতে সংক্রমণ আরও বেড়ে যেতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এমন প্রেক্ষাপটে করোনার লাগাম টানতে গত ২৩ জুলাই থেকে আবার ১৪ দিনের বিধিনিষেধ শুরু হয়, যা এখনো চলমান।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অসচেতনতা এবং সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে। এ ছাড়া একবারে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে উপস্থিতি, পাকস্থলির কার্যকারিতা ক্ষীণ নিয়ে ভর্তি, হাসপাতালে জনবল-সংকট ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম স্বল্পতা, অক্সিজেন সংকট, সতকর্তার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের উদাসীনতা ও স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন না করায় মৃত্যুর সংখ্যা পারদের মতো ওঠানামা করছে।

জুলাইয়ের শুরু থেকেই করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। ফলে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপও বেড়ে যায়। ধারণক্ষমতার বাইরে রোগী ভর্তি ছিল। তবে পরবর্তীতে হাসপাতালগুলোতে শয্যার সংখ্যা বাড়ানো হয়। বর্তমানে সেই পরিস্থিতির অনেকটা উন্নত হয়েছে। সংক্রমণও কমেছে। শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কমেছে।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে শনিবার (৩১ জুলাই) সকাল পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় মোট শনাক্ত হয়েছে ৯২ হাজার ৯৩২ জন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৩৮৮ জনে। এ সময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ৬৮ হাজার ৭৮৬ জন।

জেলাভিত্তিক করোনা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে খুলনা জেলা শীর্ষে রয়েছে। খুলনায় মারা গেছেন ৬২৪ জন। এরপর কুষ্টিয়ার অবস্থান। এই জেলায় ৫৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া যশোরে ৩৪৪ জন, ঝিনাইদহে ২০২ জন, চুয়াডাঙ্গা ১৬১ জন, মেহেরপুরে ১৩৭, বাগেরহাটে ১২৩ জন, নড়াইলে ৯২জন, সাতক্ষীরায় ৮৫ জন ও মাগুরায় ৬৭ জন মারা গেছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, খুলনা অঞ্চলে বেশ কিছু কারণে সংক্রমণ বেড়েছে। যার মধ্যে ঈদুল ফিতরে মানুষের জনস্রোত, সীমান্তবর্তী এলাকা পেরিয়ে করোনার ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়া, মানুষের অসচেতনতা, সামাজিক উদ্যোগ, নীতিনির্ধারণের সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করায় করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। সংক্রমণের জন্য যাদের আইসেলেশনে রাখা প্রয়োজন তাদের করা হয়নি।

মাস্ক পরার বিষয়ে সামাজিক জাগরণী কর্মসূচি প্রয়োজন। করোনার ধরণ পাল্টাচ্ছে। আর সেই ধরণ অনুযায়ী ভ্যাকসিন দিতে হবে। পূর্বে যারা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তারা আবারও সংক্রমিত হতে পারে। সে জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। মূলত শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যদিয়ে করোনা সংক্রমণ ছড়ায়। ফলে মাস্ক পরতে হবে, অন্তত ৬ ফিট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. জসিম উদ্দিন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগের করোনা পরিস্থিতি থেকে কিছুটা ভালো রয়েছে। কিন্তু এই ভালোকে ভালো বলা যাবে না। আমাদের আরও সচেতন থেকে চলতে হবে। বিভাগে সংক্রমণের হার এখন ২৮ শতাংশ। এটি ৫ শতাংশে না আসা পর্যন্ত সন্তুষ্ট হওয়া যাবে না।

মোহাম্মদ মিলন/এনএ