‘সন্তানদের সুশিক্ষিত করতে বিদ্যালয় নিয়ে গেলেও ভর্তি করাতেন না তখন। ছিল না পাকা রাস্তা, বিদ্যুৎ কিংবা মসজিদ-মন্দির। অনেকেই বাঁকা নজরে তাকাতেন। আবার অনেকেই বলতেন, আমরা ভারতীয় নাগরিক। আদতে ছিলাম না কোনো দেশেই নাগরিক। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থলসীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ছিটমহলগুলো বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশের নাগরিক করেছেন। বিনিময় চুক্তি না হলে আমাদের স্বপ্ন আজ পূরণ হতো না।’

রোববার (১ আগস্ট) সকালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার বিলুপ্ত ১৩৫ নম্বর উত্তর গোতামারী ছিটমহলের আমিনুর রহমান এভাবেই অভিব্যক্তি করেন। বিনিময়ের পর তিনি আর সে দেশে চলে যাননি, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে এ দেশেই থেকে যান। ফলে এখন তিনি পাচ্ছেন মৌলিক অধিকারের প্রায় সবগুলো।

আমিনুর বলেন, ভারতের বাসিন্দা হওয়ার ছিল আমাদের। সুযোগ পেয়েও আমরা ওই দেশে না গিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হয়েছি। এখন অনেক ভালো আছি। আমাদের এলাকায় এখন সরকারি সব সুবিধা বিদ্যমান। এলাকার বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতা সবই পাওয়া যাচ্ছে।

আমিনুরের মতো অনেকেই সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হয়ে ভুগেছেন কয়েক দশক ধরে। মেলেনি শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারগুলো। ছিল না তাদের ভোটাধিকার। কাগজে-কলমে ভারতীয় ভুখণ্ডের বাসিন্দা হলেও সীমান্তের কাঁটাতার থেকে তাদের অবস্থান ছিল অনেক দূরে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। 

জানা গেছে, বিলুপ্ত ১১১টি ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে লালমনিরহাট সদর ও হাতীবান্ধায় ছিল দুটি করে ও পাটগ্রাম উপজেলার অভ্যন্তরে ছিল ৫৯টি। এর বাইরে কুড়িগ্রামে ১২, নীলফামারীতে চার ও পঞ্চগড়ে ছিল ৩৬টি ভারতীয় ছিটমহল। বিনিময় চুক্তি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই লালমনিরহাটের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ভারতীয় ছিটমহলগুলোয় শুরু হয় ব্যাপক উন্নয়ন। সরকার শুরু করে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মৌলিক অধিকার বাস্তবায়ন।

ফলে এসব এলাকায় হয়েছে পাকা রাস্তা, এসেছে বিদ্যুৎ। অনেকেরই ঘরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ। ঘরে ঘরে বসানো হয় টয়লেট, নলকূপ। হয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শহীদ মিনার। সেচের জন্য বসানো হয়েছে সৌরবিদ্যুৎ চালিত পাম্প। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আসা হয়েছে ভাতার আওতায়। আবার চাকরিতে বিশেষ কোটা চালু করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সব মিলিয়ে এখন সাবেক ছিটমহলবাসীরা বেশ সুখেই আছেন।

হাতীবান্ধার উত্তর গ্রামের (বিলুপ্ত ছিটমহল) স্কুলশিক্ষক বকুল চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শান্তনা রানী রায় বলেন, আগে বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ছিল না। এখন এসব সুবিধা পাচ্ছি, আমরা অনেক ভালো আছি।

কলেজ শিক্ষার্থী আলামিন ইসলাম বলেন, এখন আমাদের লেখাপড়ার কোনো সমস্যা নেই। তবে সরকারের কাছে দাবি, চাকরির ক্ষেত্রে আমাদের জন্য আলাদা কোটা দেওয়া হোক।

লালমনিরহাট সদর উপজেলার ভেতরকুটি বাঁশপঁচাই বিলুপ্ত ছিটমহলের হারুন অর রশিদ বলেন, বিনিময়ের পর থেকে এ দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে এখানকার বাসিন্দারা। যুগ যুগ ধরে এসব থেকে বঞ্চিত ছিলেন তারা। জমিজমাও কেনাবেচা করতে পারেন। তবে রেকর্ডের সময় কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে, সেগুলো নিরসন করা দরকার।

প্রায় একই ধরনের নানা প্রাপ্তির কথা স্বীকার করেছেন পাটগ্রামের বাঁশকাটা, লতামারি, পানিশালাসহ একাধিক বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ।

উত্তর গোতামারী গ্রামের (বিলুপ্ত ছিটমহল) আজিজুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীকে কখনোই ভুলব না। কারণ, তিনি আমাদের বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীকে নাগরিক করেছেন, অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু কিছু সমস্যার সমাধান চাই আমরা। যেমন সাতটি রাস্তা পাকাকরণ করার কথা থাকলেও সেসব রাস্তা এখানকার নেতারা অন্য স্থানে নিয়ে গেছেন। তাই দ্রুত রাস্তাগুলো পাকাকরণের দাবি করছি। এসব রাস্তা পাকা হলে আমাদের আর কষ্ট থাকবে না।

এনএ