করোনাকালে যখন ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে তখন তৃতীয় শ্রেণির বিজয় হোসেনকে চা বিক্রি করতে পথে নামিয়েছে ক্ষুধা/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

রোববার রাত সাড়ে ৮টা। বগুড়ার কাহালু উপজেলার স্টেশন এলাকায় চারিদিকে আবছায়া অন্ধকার। কচিকণ্ঠে ‘চা লাগবে চা’ বলে কে যেন ডেকে উঠল। করোনাকালীন সময়ে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে চায়ের দোকান বন্ধ। তাই চাওয়ালার কণ্ঠ বেশ মিঠে লাগল।

ডাকলাম। আবছা আলোয় কাছে এলো একটি বাচ্চাছেলে। ভ্রাম্যমাণ চা বিক্রেতা। হালকা গড়নের শ্যামলা ছেলেটির একহাতে চায়ের ফ্লাস্ক। অন্যহাতে প্লাস্টিকের ব্যাগে পানির বোতল ও ওয়ানটাইম চায়ের কাপ। পা খালি, পরনে লাল-কালো রঙের গেঞ্জি ও হাফপ্যান্ট।

নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল, বিজয় হোসেন, বয়স ৯ বছর। চা খাবেন? লাল চা? লেবুও আছে। 

চা দিলো বিজয়। চা পান করতে করতে কথা হলো তার সঙ্গে। চা কেমন বিক্রি হয়-  জানতে চাইলে বলল, প্রতিদিন দুপুরের পর থেকে প্রায় ২/৩শ টাকার চা বিক্রি হয়। অর্ধেকের মতো লাভ হয়। লাভের টাকা মা আলেফা বেগমের হাতে তুলে দেয় বিজয়। 

কাহালু মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩য় শ্রেণির ছাত্র বিজয় হোসেন। কাহালু উপজেলার পৌর এলাকার সাগাটিয়া গ্রামে তার বাড়ি। বাবা দুলাল হোসেন, মা আলেফা বেগম। দুই ভাই। বিজয় ছোট। বড় ভাই আসিফ আলী ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। 

বাবা দুলাল হোসেন কী করেন? বিজয় বলে, আব্বা ফুটপাতোত যখন যে ফল পাওয়া যায় তার ব্যবসা করে। অ্যাকন করোনাকাল, ব্যবসা নাই। ঘরেত ক্ষিদা আর স্কুল বন্দ আচে। তাই আমি লাল চা বেচি। 

বাবার ফলের ব্যবসা সম্পর্কে বিজয় বলে, করোনাভাইরাস আটকানের জন্নি সরকার লকডাউন দিচ্চে। বার বার দিচ্চে। আব্বা কাহালু বাজার এলাকার বিভিন্ন জাগাত ফুটপাতোত বসে ফলের ব্যবসা করিচ্ছল। কিন্তুক অ্যাকন সারাদিন পুলিশ, আর্মি, বিজিবি ঘুরে বেড়ায়। তাই ঠিক মতো দোকান লাগাবার পারে না। দোকান না লাগাবার পারলে বেচা হয় না। আবার দোকান লাগালেও গাড়ি চলবার দেয় না পুলিশ। তাই মানুষজনও ফল কেনার জন্নি আসপার পারে না। তাই বাড়িত অ্যাকন ম্যালা অভাব- কষ্ঠ। বিকেল থ্যাকা আত ৮টা/৯টা পন্ত তাই লাল চা বেচি। আর বেচা ভালো হলে ১০০-১৫০ ট্যাকাও লাভ হয়। লাভ যা হয় মায়ের হাতে তুলে দেই। মা সেই ট্যাকা দিয়ে চাল-ডাল কিনে, হামাকেরেক ভাত রান্দে খিলাই।

চা বিক্রি করতে কেমন লাগে- এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, বাড়িত পড়ি, দিনের বেলা। বিকেল থ্যাকা চা বেচা লাগে। মা সব রেডি করে ফ্লাকসোত তুলে দেয়। হামি লিয়ে বেড়ায় আর বেচি। একবার চা শেষ হলে আবার বাড়িত যাই ফ্লাকসোত চা লিবার। আবার লিয়ে আসিম আবার চা বেচি। বাজার, স্টেশন, স্কুল, চারমাথা, হাসপাতাল, উপজেলার আশপাশে, কলেজের মাঠের পাশে চা বেশি বেচা হয়। 

বিজয়ের চা-টা মন্দ নয়। চা শেষ করে তাকে নিয়ে রাস্তার পাশে একটি ওষুধের দোকানের বারান্দায় গিয়ে ছবি তোলেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক। চায়ের দাম নিয়ে বিজয় আবার ‘চা লাগবে চা, লাল চা’ ডাক দিতে দিতে এগিয়ে যায়।

স্থানীয়দের মাধ্যমে তার বাবা দুলাল হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। রোববার (১ আগস্ট) দুলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, লকডাউনে এখন দিন যায় না। একবেলা খাবার জোটে না ঠিকভাবে। সরকারি কোনো সাহায্যও পাই না। আর ফুটপাতে এখন ফলের দোকান বসানো যায় না। প্রশাসনের লোকজন ঝামেলা করে। মোবাইল কোর্ট জরিমানা করে। তাই সংসার চলে না। বিজয় ছোট তাই লাল চা ফ্লাস্কে করে বেচে। চা বেচে যা লাভ হয় তা দিয়ে সংসারে অল্প হলেও সাহায্য হচ্ছে। 

দুলাল বলেন, বিজয় পড়াশোনার খুব আগ্রহী। কিন্তু এখন পেট চলে না। পেট চললে বাঁচা যাবি। বেঁচে থাকলে, স্কুল খুললে বিজয় আবার পড়বে।

তিনি আরও বলেন, সমাজের বিত্তবানরা যদি সমস্যাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান খুব ভালো হয়। তাহলে করোনায় কোনো পরিবারকে না খেয়ে থাকতে হবে না। করোনার ঝুঁকি নিয়ে বিজয়ের মতো শিশুকেও ফ্লাস্ক নিয়ে বের হতে হবে না। 

বিজয়ের চা বিক্রয়ের বিষয়ে কাহালু থিয়েটারের সভাপতি আব্দুল হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ক্ষুধা যখন দরজায় টোকা দেয়, করোনার ভয় তখন জানালা ভেঙে পালায়। পেটের দায়ে তাই বিজয়য়ের মতো শিশু আজ চা বিক্রি করছে। ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া  স্বাধীন দেশে বিজয়রা যেন জয়ী থাকে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। 

এইচকে