এক বল নিয়ে কাড়াকাড়ি!
‘হুমগুটি’ খেলা দেখতে আসা মানুষের ঢল
'হুমগুটি' খেলা। নামটা অনেকের অজানা হলেও ময়মনসিংহবাসীর কাছে খুবই পরিচিত এক নাম। যে খেলা দেখতে প্রতি বছর ঢল নামে মানুষের। খেলাস্থল পরিণত হয় জনসমুদ্রে। করোনাকালীন হলেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি এবারও।
৪০ কেজি ওজনের পিতলের তৈরি বলের মতো দেখতে একটি বস্তু— যার নাম 'গুটি'। এটি দিয়েই হয় হুমগুটি খেলা। জমিদার আমল থেকে ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলায় প্রতি বছর পৌষ মাসের শেষ দিন হয় ঐহিত্যবাহী এ খেলা।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) পৌষের বিকেলে পশ্চিম আকাশে তখন হেলে পড়েছে সূর্য। উপজেলার লক্ষ্মীপুর ও দশমাইল এলাকার মাঝামাঝি তালুক-পরগনা সীমান্তকে ঘিরে অপেক্ষমাণ লাখও জনতা।
লক্ষ্মীপুরের দৌলত মোড়লবাড়ি থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই গুটিটি মাথায় করে নিয়ে আসা হয় সেই সীমান্তে একটি বাঁশে বাঁধা লাল নিশানের নিচে। বাঁশিতে ফুঁ দিতেই শুরু হয় খেলা। এটি এমনই এক খেলা, যেটাতে খেলোয়াড় সংখ্যা অগণিত। তবে নেই কোনো রেফারি। এ যেনো শক্তির লড়াই।
বিজ্ঞাপন
এক গুটি নিয়ে কাড়াকাড়িতে ব্যস্ত সবাই। মানুষের চাপে গুটির অবস্থান বোঝা না গেলেও পেছনে ছুটাছুটি আর উল্লাসের কমতি নেই।
স্থানীয়রা জানায়, পৌষ মাসের শেষ বিকেলকে এ উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় 'পুহুরা'। প্রতি বছর এই দিনে একই সময়ে একই স্থানে হুমগুটি খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় এ হুমগুটি খেলাকে কেন্দ্র করে ফুলবাড়িয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর, দেওখোলাসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামে কয়েকদিন দিন আগে থেকে খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত চলে উৎসবের আমেজ।
জানা গেছে, ১৭৫৮ সালে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশিকান্তের সঙ্গে ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূখণ্ডে দুই নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রতিবাদী আন্দোলন।
জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মীমাংসা করতে লক্ষ্মীপুর গ্রামের বড়ইআটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এ গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’।
জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। এভাবেই তালুক পরগনার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারী এই খেলার গোড়াপত্তন।
জমিদার ও জমিদার প্রথা না থাকলেও সেই হুমগুটি খেলাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এলাকাবাসী। খেলায় মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ সদর ও ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে দল বেঁধে হাজার হাজার খেলোয়াড় ও উৎসুক জনতা আসে খেলাটি দেখতে।
এ খেলায় একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে। ওই নিশানা দেখে বোঝা যায় কারা কোন পক্ষের লোক। ‘গুটি’ কোন দিকে যাচ্ছে— তা মূলত চিহ্নিত করা হয় নিশানা দেখেই। নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। এভাবে গুটি ‘গুম’ না হওয়া পর্যন্ত চলে খেলা।
হুমগুটি সাংস্কৃতিক ফোরামের পরিচালক এবি ছিদ্দিক বলেন, জমিদার আমল থেকে হুমগুটি খেলা হয়ে আসছে। বংশপরম্পরায় আমার পূর্বপুরুষরা ঐতিহ্যবাহী খেলাটির আয়োজন করেছে। এখন আমরা করছি। এরপর পরবর্তী প্রজন্ম করবে— এভাবে চলতেই থাকবে।
এদিকে খেলাকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এ খেলা। অতীতে টানা দুই-তিনদিন পর্যন্ত খেলা চলার নজিরও আছে।
এসএমআর