পানি বাড়লেই যে হাটে জমে ওঠে ডিঙি নৌকার বেচাকেনা
শাহজাদপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এ হাটে পসরা হয় শতাধিক ডিঙির
যমুনা ও চলনবিল-অধ্যুষিত জেলা সিরাজগঞ্জ। জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে ৭টি উপজেলাই বন্যাকবলিত। বছরের অনেকটা সময় পানির সঙ্গেই কাটে এ জেলার মানুষের। সঙ্গে যমুনার ভাঙাগড়ার খেলা যেন নিত্যসঙ্গী। অনেকের জীবিকাও আবার এই পানিকে ঘিরেই। পাশাপাশি এই বর্ষাকালে মৌসুমি মৎস্যচাষির সংখ্যাও কম নয়।
এদিকে কয়েক দিন ধরে চলনবিলে যেমন পানি বাড়তে শুরু করেছে, তেমনি বাড়ছে সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীতে। আর এতে জেলার কয়েকটি হাটে জমে উঠেছে নৌকা বেচাকেনা। এর মধ্যে অন্যতম একটি হাট হলো জেলার শাহজাদপুরের কৈজুরি হাট। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্রেতা-বিক্রেতায় মুখর হয়ে ওঠে যমুনা নদীতীরবর্তী এ হাটটি।
বিজ্ঞাপন
নৌকা তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার অসংখ্য কাঠমিস্ত্রি। অনেকেই আবার শুধু বর্ষা মৌসুমেই করেন এসব কাজ। নিম্নাঞ্চল হিসেবে পরিচিত শাহজাদপুরে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে কেজুরী হাটে রেকর্ড সংখ্যক নৌকা বেচাকেনা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে এই উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যাওয়ায় ভেঙে পড়ে যোগাযোগব্যবস্থা। যখন যোগাযোগের শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়ায় এই নৌকা।
সপ্তাহের শুক্রবার যমুনা নদীতীরবর্তী শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী মাদ্রাসা মাঠে বসে নৌকার হাট। এখানে ছোট, বড় ও মাঝারি নৌকার পসরা সাজিয়ে বসে থাকেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বিক্রেতারা। নৌকা ও লগি-বইঠা কিনতে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসেন ক্রেতারাও। নিত্যনতুন নৌকা সাধারণত ৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বেচাকেনা হয় এই হাটে। শাহজাদপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে এ হাটে আনা হয় কয়েক শতাধিক ডিঙি।
চর-কৈজুরী থেকে হাটে আসা নৌকা ক্রেতা সালাম আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, যমুনা নদীতে পানি বাড়ায় সেই পানি নদীর পাড় ডিঙিয়ে বাড়ির চারপাশে থইথই করছে। এ সময়টায় এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যেতে নৌকাই একমাত্র বাহন। আরও আগেই নৌকা কেনা দরকার ছিল বলেও জানান তিনি।
বিজ্ঞাপন
একই গ্রামের নৌকা ব্যবসায়ী মনি ব্যাপারী জানান, শুধু বর্ষা মৌসুম এলেই নৌকা বিক্রি ভালো হয়। বছরের অন্য সময় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। নৌকার ব্যবসা এখন অনেকটাই মৌসুমি ব্যবসা হয়ে পড়েছে।
হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা রহমান শেখ ও কোরবান আলী ঢাকা পোস্টকে জানান, নৌকা কেনাবেচা আমাদের পৈতৃক ব্যবসা। এ ছাড়া বাড়িতেই আমাদের নিজস্ব কারখানা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ থেকেই কিশোর বয়সে বাবার সঙ্গে নৌকা বিক্রি করতে এই কৈজুরী হাটে আসতাম। তখন ১০ হাত লম্বা একটি ডিঙি নৌকা সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হতো। এখন সেই নৌকা বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকায়।
বর্ষায় আগের দিনে ডিঙি নৌকার কদর বেশি ছিল। এখন সড়কপথে যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় নৌকার কদর কমে গেছে। আগে সারা বছর নৌকার চাহিদা থাকত। তাই বিক্রি ভালো হতো। বর্তমানে ব্যবসা খুবই মন্দা, সেই সঙ্গে মিস্ত্রির মজুরি অনেক বেশি। তিনি কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে বলেন, পৈতৃক ব্যবসা ছাড়তেও পারছি না, আবার ধরেও রাখতে পারছি না। তবু লাভ কম হলেও ব্যবসা ধরে রেখেছি।
স্থানীয় কাঠমিস্ত্রি কমল কুমার সূত্রধর জানান, সপ্তাহে তাদের কারখানা থেকে ৫-৬টি নৌকা হাটে নিয়ে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে লোহা ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচ বেড়েছে। নৌকার আকার ও প্রকারভেদে ৬ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে লাভের অংশ আগের থেকে কমে গেছে।
তিনি আরও বলেন, সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই হাটে বিক্রেতারা নৌকা সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখেন। এ ছাড়া প্রায় সপ্তাহজুড়েই কম-বেশি নৌকা বিক্রি হয় এই হাটে।
ডায়া বাজারের নৌকা তৈরির কারখানার মালিক আসলাম শেখ জানান, কাঠমিস্ত্রিদের মজুরি ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকার দাম বেড়েছে। প্রতিটি ডিঙি নৌকার জন্য একজন মিস্ত্রিকে ৭০০ টাকা মজুরি দিতে হচ্ছে। তারপরও এ বছর আগাম নৌকার অর্ডার ভালোই পাওয়া যাচ্ছে।
কৈজুরী হাটের ইজারাদার মো. পেশকার আলী জানান, পাবনার বেড়া, শৈলজানার চর এবং শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী, চর-কৈজুরী, পাঁচিল, জামিরতা, গুদিবাড়ি রতন দিয়া, ধীতপুর থেকে বহু মহাজন ডিঙি নৌকা বিক্রির জন্য এ হাটে নিয়ে আসে। অনেক বছর হলো হাটটি চললেও সবাই এখনো আস্থার সঙ্গে এখানে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
কৈজুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রসিদ্ধ ও অনেক পুরোনো হাট এটি। অনেক বছর আগে থেকেই প্রতি শুক্রবার এই নৌকার হাট বসে। হাটে বিক্রির জন্য বেড়া, চৌহালীসহ বিভিন্ন উপজেলা থেকে শতাধিক ডিঙি আনা হয়।
তিনি আরও বলেন, নদীর নাব্য-সংকটের কারণে বর্ষার পরপরই নদীপথ হারিয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা দ্রুত সমাধান করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।
এনএ