২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে ঘটে ইতিহাসের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার ঘটনা। সেদিন ভয়াল সেই হামলায় দলের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন, আহত হন প্রায় ৫০০ মানুষ। তাদের সঙ্গে নিহত হন মাহবুবুর রশিদ। যিনি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনার দেহরক্ষী হিসেবে কাজ করতেন।

কিন্তু ১৭ বছর অতিবাহিত হলেও আজ তার পরিবারের খোঁজখবর নেয় না কেউ। টাকার অভাবে সন্তানের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে পারেননি মাহবুবুরের বৃদ্ধ মা-বাবা। যদিও অন্যান্য বছরগুলোতে সারা বছরের জমানো টাকা দিয়ে ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতেন তারা।

ছেলেকে হারিয়ে মাহবুবুরের বাবা-মা এখন নিঃস্ব। সহায়-সম্বল বলতে তেমন কিছুই নেই। রোগ-শোকে আক্রান্ত হয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটছে তাদের। অভাব-অনটন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। এই বয়সে এসে ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন বৃদ্ধ মা-বাবা।

কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার জয়ন্তী হাজরা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ফুলবাড়ী গ্রামের মোল্লাপাড়ার হারুন অর রশিদের (৭৫) ছেলে মাহবুবুর রশিদ। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেজ। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেহরক্ষী হিসেবে যোগদান করেন তিনি। এর আগে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স করপোরাল পদে কাজ করেছিলেন।

মাহবুবুর রশিদের বৃদ্ধা মা হাসিনা বেগম বলেন, সব সময়ই ছেলের কথা মনে হয়, খুব কষ্ট হয়। ছেলে হারানোর যে কী বেদনা, যে হারায় সে-ই বোঝে। আগে নিজেদের টাকায় ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতাম। অর্থের অভাবে এ বছরু পালন করতে পারিনি। আজকেও (২১ আগস্ট) আমাদের কেউ কোনো খোঁজখবর নেয়নি। বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে, হয়তো বেশি দিন বাঁচব না। আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, মরার আগে সেই অপরাধীদের ফাঁসি চাই।

তিনি আরও বলেন, টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। ওষুধপত্র কেনা ও সংসার চালাতে যে কী কষ্ট হচ্ছে, তা কেউ বুঝবে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্থিক সহযোগিতার আবেদন জানাচ্ছি।

স্থানীয় বাসিন্দা রতন বলেন, আওয়ামী লীগের সমাবেশে জীবন দিয়ে তার কী লাভ হলো! তার মৃত্যুবার্ষিকীতে কেউ তার খোঁজখবর নেয় না। সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, তার স্মৃতি রক্ষার জন্য যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হোক এই গ্রামে। তাহলে তার স্মৃতি রয়ে যাবে, তা না হলে একদিন তার স্মৃতি হারিয়ে যেতে পারে।

স্থানীয় বাসিন্দা শ্যামল বলেন, মাহবুবুরের বৃদ্ধ মা-বাবা অসুস্থ। তাদের দেখার মতো কেউ নাই। অর্থের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তারা। প্রধানমন্ত্রী তাদের দিকে দৃষ্টি দিলে বা আর্থিক সহায়তা করলে তারা একটু শান্তিতে জীবন পার করতে পারতেন।

মাহবুবুর রশিদের সেজ ভাই ভ্যানচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার ভাইয়ের নামে এলাকায় কোনো স্মৃতিচিহ্ন নাই। আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে। ভাইয়ের স্ত্রীও দুই ছেলেকে নিয়ে অভাবের মধ্যে আছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আমাদের কোনো খোঁজখবরও নেয় না। সেদিনের সেই নারকীয় ঘটনায় আমার ভাই জীবন দিয়েছিলেন। কিন্তু দলের কেউ আমাদের সন্মান করেনি, আমার ভাইকে মনে রাখেনি। ভাইয়ের নামে একটা প্রতিষ্ঠান করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

শনিবার বিকেলে তাদের বাড়ি গেলে মাহবুবুর রশিদের বোন আবিদা ও চায়না খাতুন জানান, ২১ আগস্ট এলেই সাংবাদিকরা খোঁজখবর নেন। এ ছাড়া আর কেউ এই পরিবারের খোঁজখবর রাখেন না। আওয়ামী লীগের নেতারাও আমার বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ নেন না।

তারা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে যে টাকা দেয়, তা দিয়ে ওষুধ কেনা ও সংসার চালাতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া করোনায় কোনো সরকারি সহায়তা পাননি। সরকার সাহায্য করলে আমার মা-বাবা সচ্ছলভাবে জীবনযাপন করতে পারতেন।

মাহবুবুর রশিদের বাবা হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতি মাসে ‘কল্যাণ ফান্ড’ থেকে যে টাকা দেওয়া হয়, তা দিয়ে দুজনের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। টাকার অভাবে এবার মিলাদ-মাহফিল করতে পারলাম না। আমাদের খোঁজ কেউ নেয় না। ২১ আগস্ট এলে শুধু সাংবাদিকরা খোঁজ নেয়। কিন্তু দিবসটি চলে গেলে সবাই ভুলে যায়। মৃত্যুর আগে ছেলের হত্যাকারীদের বিচার দেখে যেতে চাই।

এনএ