বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস বাংলাদেশে হানা দেওয়ার প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এ সময়ে দেশে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। থেমে থেমে এসেছে বিধিনিষেধ, লকডাউন ও কঠোর লকডাউন। এ কারণে শিল্প-কলকারখানা, শপিং মল, দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দরজাও বন্ধ করতে হয়েছে।

থেমে থেমে চলা এসব বিধিনিষেধের কারণে দেশের অর্থনীতিও চলছে থেমে থেমে। যার প্রভাব পড়েছে জয়পুরহাট জেলার ব্র্যান্ডিং শিল্প সোনালি মুরগিতে। এই দেড় বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো লোকসান গুনেছেন বলে জানান পোলট্রি শিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীরা।

জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস এবং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসে আগে জেলাজুড়ে প্রায় ১০ হাজার খামারি এই পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বর্তমানে তা অর্ধেকের কাছাকাছি চলে এসেছে। এর মধ্যে আবার অনেক বড় খামারি ব্যবসা ছোট করে ফেলেছেন। ব্যবসার জন্য মাঠপর্যায়ে যে টাকা পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেই টাকা উঠবে কি না, তা নিয়েও হতাশায় আছেন বিনিয়োগকারীরা।

যেভাবে হচ্ছে লোকসান
একের পর এক লকডাউন চলার কারণে আমাদের পোলট্রির ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে, এতে নিরাশ হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা, এমন কথা জানিয়ে শেফালী পোলট্রি অ্যান্ড ফার্ম প্রাইভেট লিমিটেডের ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার আগে মুরগির বাচ্চা প্রতি পিস বিক্রি করা হয়েছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা, বাচ্চা ফোটানোর একটি ডিম ছিল ১৪ থেকে ১৫ টাকা, বাজারে মুরগির দাম ছিল কেজিপ্রতি ২২০ থেকে ২৮০ টাকা। লকডাউনের পর এখন বাচ্চা ফোটানোর ডিম প্রতিটি ৬ থেকে ৮ টাকা, বাচ্চার দাম সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ টাকা, বাজারে প্রতি কেজি মুরগির দাম ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা।

এর মধ্যে আবার খাদ্যের দাম পর্যায়ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। বস্তাপ্রতি ৭৫ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত ভুট্টা, সয়াবিন, প্রোটিন, অন্যান্য ওষুধের দাম দিন দিন ব্যাপক হারে বাড়ছে। করোনার আগে সয়াবিন কেজিপ্রতি ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা, বর্তমানে তা ৫৩ থেকে ৫৪ টাকা কেজিতে কিনতে হচ্ছে। ভুট্টা ছিল ১৬ থেকে ১৭ টাকা কেজি, এখন ২৬ থেকে ২৭ টাকা কেজি। প্রোটিন ছিল ১১২ টাকা কেজি, বর্তমানে ১৪০ টাকা।

তিনি বলেন, একটি বাচ্চার খরচ পড়ে ১৩ থেকে ১৪ টাকা। অথচ বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৮ টাকা। লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রায় ৫ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে তো পথে বসতে হবে আমাদের। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে পোলট্রি খামারে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ব্যাংক যদি ছাড় দেয়, তাহলে আবার দাঁড়াবে পোলট্রি শিল্প। তা না হলে অসম্ভব।

পোলট্রি ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ
মেসার্স এসএসবি পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী ইসমাঈল হোসেন টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় সব কাঁচামালের দাম বেশি। অথচ মুরগির বাজার নেই। প্রণোদনার ২২ হাজার টাকা পেয়েছি। এই সীমিত টাকা দিয়ে তেমন কিছু করা সম্ভব নয়। পোলট্রি শিল্প খাত ধ্বংসের শেষ প্রান্তে আছে।

জানতে চাইলে শেফালী পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি প্রা. লি.-এর হিসাবরক্ষক শিবলু কুমার মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার আগে মুরগি, ডিম ও বাচ্চার যে বাজার ছিল, বর্তমানে করোনাকালীন সেই বাজার পাওয়া যাচ্ছে না। এখন আমরা যে অবস্থায় দাঁড়ায়ছি, এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে আমাদের পোলট্রি শিল্প ধ্বংসের দিকে চলে যাবে। আমরা পুঁজি খুঁজে পাব না।

পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মচারী এনামুল হোসেন, মিনহাজুল ইসলাম, সোবাহান হোসেন বলেন, আমাদের পোলট্রি খামারে লোকবল আছে ৭০ থেকে ৮০ জন। এই ব্যবসায় ধস নেমেছে। মহাজনের অনেক টাকা লস। তাই মহাজন আমাদের বাদ দিতে চান। আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? কীভাবে পরিবার নিয়ে বাঁচব?

লোকসানে বন্ধ পোলট্রি ব্যবসা
লোকসানের মুখ দেখায় প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ আছে সাহারা পোলট্রি ফার্ম অ্যান্ড হ্যাচারি কমপ্লেক্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. মাহফুজুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার প্রায় দেড় বছর ধরে মুরগির খামারিরা ব্যাপকভাবে লোকসানে আছেন। মুরগির খাদ্য তৈরি উপকরণের দামও বেড়ে গেছে। কিন্তু সে তুলনায় বাজারে মুরগির দাম বাড়ে না। করোনার শুরুর পর থেকেই এ পর্যন্ত আমরা খামারিরা ব্যাপক লোকসানের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছি।

যা বলছেন পোলট্রি শিল্পের ব্যবসায়িক নেতারা
বাংলাদেশ সোনালী মুরগি উৎপাদন ও বিপণন সমিতির আহ্বায়ক কবির আকবর চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে করোনা পরিস্থিতি আবার লকডাউন। এতে পোলট্রি মুরগি খাতে ব্যাপক ধস। উৎপাদনমূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ লোকসান দিয়ে খামারিরা মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ, মুরগি যত লালন-পালন করা হবে, ততই লোকসান বাড়বে। এভাবেই আমাদের সব টাকা মাঠে ব্লক হয়ে গেছে। আমরা কোনোভাবেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারছি না।

তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের হাতে আর কোনো মূলধন নেই। ব্যাংকের ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারছি না। তাদের যে সুদ আসে, তাও দেওয়া যাচ্ছে না। আমাদের ওপর ব্যাংকের চাপ ব্যাপকভাবে আসছে। আমরা এই চাপ নেব, নাকি ব্যবসা চালাব? আমরা যারা বিনিয়োগকারী আছি, তাদের সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ জড়িত। এভাবে চলতে থাকলে সবার জীবন শেষ হয়ে যাবে।

জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম আনু ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার এই দেড় বছরে পোলট্রি শিল্প একেবারেই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। কারণ, করোনাকালীন সরকার কর্তৃক যে বিধিনিষেধ চলল, এতে সোশ্যালওয়ার্ক বন্ধ ছিল। ফলে এই শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা ৫০ শতাংশের নিচে নেমেছে। এতে এই শিল্পের যারা ইনভেস্টার, ফার্মার সব পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত।

তিনি বলেন, সরকার ইতিমধ্যে প্রণোদনা দিয়েছে। তবে সেই প্রণোদনা পর্যাপ্ত নয়। যেটুকু দিয়েছে তা দিয়ে কিছু খামারি উপকৃত হচ্ছে, কিন্তু এটি অপ্রতুল্য। আজকের যে পরিস্থিতি, এ থেকে উত্তরণ পেতে গেলে সরকারের আরও বড় পদক্ষেপ নিতে হবে, যা থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়ে এ শিল্প আবার ঘুড়ে দাঁড়াতে পারে।

তিনি আরও বলেন, প্রণোদনার প্যাকেজ নিয়ে সরকারের যে উদ্দেশ্য এবং যেভাবে ডিস্ট্রবিউশন করার কথা, ব্যাংকগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তা ঠিকমতো ডিস্ট্রবিউশন হচ্ছে না। অর্থাৎ প্রান্তিক পর্যায়ের যেসব ব্যবসায়ী আছেন, তারা ঠিকমতো এটা পাচ্ছেন না। এই দেড় বছরে পোলট্রি শিল্পে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

প্রডিউসার গ্রুপ অর্গানাইজেশন সৃষ্টিতে লোকসান কমার আশা
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মাহফুজার রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনায় অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন। ইতিমধ্যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে অনেক খামারি এখনো টিকে আছেন। আমরা অনুধাবন করছি যে মার্কেট ডেভেলপমেন্ট না করতে পারলে সারা বছর খামারিদের সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দেওয়া সম্ভব হবে না।

এ জন্য এলইডিপি প্রকল্পের অর্থায়নে দেশব্যাপী প্রডিউসার গ্রুপ অর্গানাইজেশন সৃষ্টি করা হচ্ছে। অচিরেই আগামী ৬ মাস বা তার কম সময়ে এগুলো অ্যাকশনে যাবে। যাতে প্রান্তিক পর্যায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রডিউসার অর্গানাইজেশন সংগঠন দাঁড় করায়ে তাদের মাধ্যমে আমরা সরাসরি কোনো উৎপাদিত পণ্য সরবরাহ করতে পারব। যেহেতু জয়পুরহাট সারপাস একটি জেলা, সেহেতু এখানকার উৎপাদিত পোলট্রি অনায়াসে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হবে। এতে অনেক খামারি লোকসান থেকে বেরিয়ে আসবেন।

প্রণোদনার ক্ষেত্রে ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে এই প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা বলেন, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছিল। আমরা তার ব্যবস্থা নিয়েছি। আবারও এ রকম কোনো বিষয় এলে তা সমাধান করা হবে। একটি মিটিংয়ে কাগজপত্রে ঝামেলা ছাড়া সোনালী ব্যাংক স্বল্প সুদে ৫০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি সেখানে ১ লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব রাখি। প্রয়োজনে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে ডিসি স্যারও কথা বলতে চেয়েছেন।

এনএ