পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর শব্দ ‘মা’। মায়ের কোল সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নিরাপদ স্থান। কিন্তু সেই মা যদি হয় সন্তানের হন্তারক, তবে সেটি হয়ে দাঁড়ায় সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। নিজের দুই মাসের সন্তানকে হত্যার ১৫ মাস পর আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন সেই মা খাদিজা আক্তার ওরফে পিংকি। 

পারিবারিক কলহে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে নিজের সন্তানকে রাতের আঁধারে ছুড়ে ফেলেছিলেন বাড়ীর পাশের পুকুরে। দুই দিন পর লাশ পাওয়া গেলে এই হন্তারক মায়ের আহাজারিতে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি এলাকাবাসী। ঘুমের মধ্যে বাচ্চাকে চুরি করে কেউ হত্যা করেছে এমনটাই ছিল তার বয়ান। কিন্তু শেষ অবধি একটি ছোট্ট চিরকুটকে ঘিরে পুলিশের তদন্ত বেড়িয়ে এসেছে এই লোমহর্ষক কাহিনীর নেপথ্য।
 
জানা গেছে, গত বছরের ২১ এপ্রিল জেলার বন্দর উপজেলার মাধবপাশা এলাকায় নিখোঁজের দুই দিন পর বাড়ীর পাশের পুকুরে মিলেছিল দুই মাস বয়সী শিশু ইমাম হোসেনের লাশ। নিহত ইমামেরর বাবা রুবেল মিয়া ছেলে হত্যার দায়ে অজ্ঞাত আসামিদের নামে মামলা করেছিলেন বন্দর থানায়। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা রুবেল ওই বাড়িতে পেয়েছিলেন একটি ছোট্ট চিরকুট। যাতে লেখা ছিল, ‘বাচ্চা গড়ে গড়ে চুরি করমু সাবথান’। এই চিরকুটই শেষ পর্যন্ত শিশু ইমাম হোসেন হত্যা মামলায় আলো ফুটিয়েছে। 

রোববার (৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নরুন্নাহার ইয়াসমিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় খাদিজা আক্তার ওরফে পিংকি জবানবন্দি দেন। তিনি স্বীকার করেন যে, তিনিই তার সন্তানের হত্যাকারী। দাম্পত্য কলহের জেরে তিনি এই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলা কার্যালয়ের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৯ এপ্রিল দিবাগত রাত ১২টার দিকে বন্দরের মাধবপাশা (কান্দিপাড়া) গ্রামের জাবেদ আলীর বাড়ি থেকে ইমাম হোসেন নামে দুই মাস বয়সী শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরে ২১ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে বাড়ির পাশের পুকুরে ওই শিশুর মরদেহ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় নিহতের বাবা মো. রুবেল একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। 

ওই সময় নিহতের মা খাদিজা আক্তার পিংকি জানিয়েছিলেন, ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় তার শিশু সন্তানকে কেউ চুরি করে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে মামলার তদন্ত ভার দেওয়া হয় পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলাকে। 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক সাইফুল আলম গত বছরের ৩০ জুলাই মামলার তদন্ত শুরু করেন। পরিদর্শক সাইফুল আলম জানান, তদন্তের এক পর্যায়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে আসামির বাসা থেকে সাত শব্দে লেখা একটি ছোট্ট চিরকুট উদ্ধার করা হয়। সেখানে লেখা ছিল, ‘বাচ্চা গড়ে গড়ে চুরি করমু সাবথান’। এই কাগজের লেখার সঙ্গে মিল খোঁজার জন্য পরিবারের লোকজনসহ আশেপাশের অনেকের নমুনা লেখা সংগ্রহ করা হয়। পরে নিহত শিশুর মা খাদিজার হাতের লেখার সঙ্গে ওই লেখার মিল পাওয়া যায়। আদালতের মাধ্যমে নমুনা লেখা বিশেষজ্ঞ (ব্যালেস্টিক) দ্বারা তুলনামূলক পরীক্ষা করেও মিল পাওয়া যায়। এরপর খাদিজা আক্তারকে পিবিআই হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এক পর্যায়ে তিনি সব কিছু স্বীকার করেন।

পিবিআই জেলা পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম বলেন, ক্লু-লেস এই হত্যা মামলার দীর্ঘ সময় পর একটি চিরকুটের সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। চিরকুটের মাধ্যমেই মামলার জট খোলা শুরু করে। পরে নিহত শিশুর মাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের পর জিজ্ঞাসাবাদের পর তিনি শিশু সন্তানকে পানিতে ফেলে হত্যার কথা স্বীকার করেন। 

তিনি বলেন, আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। পারিবারিক কলহের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। তারা উভয়ই আলাদা বসবাস করত। ওই শিশু তাদের একমাত্র সন্তান ছিল। এই ঘটনায় নিহতের পিতার কোনো সংযোগ বা সম্পৃক্ত পাওয়া যায়নি।

এদিকে আদালত সূত্র জানিয়েছে, নিজের দেওয়া জবানবন্দিতে খাদিজা আক্তার বলেছেন, তার স্বামী রুবেল তাকে বারবার টাকার জন্য চাপ দিত। স্বামী তাকে উপার্জন করে সংসার চালানোর কথা বলত। তাকে ভরণ-পোষণ দিত না। এ নিয়ে পরিবারের লোকজনেরও উপহাস শুনতে হয়েছে তাকে। নানা ধরনের চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে সে তার দুই মাসের ছেলেকে ঘরের পাশের পুকুরে ফেলে দেয়।

রাজু আহমেদ/ওএফ