সংসারের হাল ধরছে হাওরের শিশুরা
‘সোনা বন্ধু তুই আমারে করলি রে দিওয়ানা, মনে তো মানে না দিলে তো বুঝে না, সোনা বন্ধুর এমনই গুন, জল দিলে নিভে না আগুন, কি দিয়ে নেভাব আগুন আমায় একটু বলো না, মনে তো মানে না দিলে তো বুঝে না’-টাঙ্গুয়ার হাওরে আবদুল গফুর হালীর জনপ্রিয় এই গান করছিল তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের জয়পুর গ্রামের শিশু জয় হোসেন। টাঙ্গুয়ার হিজল কচর বাগে এ রকম গান শুনে মাদকতা জন্মায় পর্যটকদের মনে।
হাওর আর পাহাড়ের মিতালির জায়গা টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের গান শুনিয়ে সংসার চালায় জয় হোসেন। হাওরের বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে বেড়ে উঠা জয় হোসেনের মতো অংসখ্য শিশুর রোজগারের মাধ্যম পর্যটকদের ছোট নৌকায় ঘুরিয়ে গান শোনানো। প্রতিদিন শতাধিক পর্যটককে এভাবেই গান শুনিয়ে অসচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়াচ্ছে হাওরপাড়ের সংগ্রামী শিশুরা।
বিজ্ঞাপন
জয় হোসেন জয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে বলে, তার বাবার একার আয় দিয়ে পরিবার চলে না। তাই সে ছোট নৌকা নিয়ে বের হয়েছে। পর্যটকদের করচ বাগে ঘুরে ঘুরে গান শুনাই। এতে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা আয় হয়।
বিজ্ঞাপন
একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জুনায়েদ। জুনায়েদের মতে, বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সে টাঙ্গুয়ার ওয়াচ টাওয়ারে ছোট নৌকা নিয়ে এসেছে। তার বাবা মো. নাজিম উদ্দিন কাজ করতে পারে না। তার রোজগার দিয়ে পরিবার চলে।
অভিভাবক মো. নুর হোসেন বললেন, এলাকায় কোনো কাজ নেই। হাওরেও মাছ ধরা যায় না। তাই বাচ্চাকে নিয়ে প্রতিদিন ওয়াচ টাওয়ারে যাই। সেখানে গিয়ে পর্যটকদের নিয়ে ঘুরি। আমার বাচ্চা গান শোনায়। এতে তারা খুশি হয়ে কিছু টাকা দেয়। সে টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালাই।
শুধু টাঙ্গুয়ার হাওর নয়, শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী) এলাকায় ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়ে সংসারের হাল ধরেছে মেঘালয়ের পাশে বসবাস করা সংগ্রামী শিশুরা। তারা জানায়, ফল, শরবত বিক্রি করে প্রতিদিন ৩০০-৩৫০ টাকা রোজগার করতে পারে। সে টাকা পরিবারের হাতে তুলে দেয়। তাদের এই উর্পাজনের টাকা দিয়ে নিম্ন আয়ের এসব পরিবার চলে।
লালঘাট গ্রামের বাসিন্দা নবী হোসেনের ছেলে মো. সোহাগ মিয়া। পরিবারের অসচ্ছলতার কারণে ট্যাকেরঘাট এলাকায় ফেরি করে ফল বিক্রি করছে। প্রতিটি ফল ৫-১০ টাকা করে বিক্রি করে।
সোহাগ বলে, প্রতিদিন ৬০-৭০টি ফল বিক্রি করে তার ৩০০-৩৫০ টাকা হয়। শুক্র-শনিবার মানুষ বেশি আসে। সেদিন আরও বেশি বেচাকেনা হয়।
এসব পর্যটন এলাকায় ঘোড়ায় চড়ে ছবি কিংবা সেলফি তুলতে রয়েছে বাহারি সাজের ঘোড়া। এসব বাহারি সাজের অনেক ঘোড়ার চালক রয়েছে শিশু। সারাদিনে ঘোড়া দিয়ে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়। সেগুলো তারা পরিবারের হাতে তুলে দেয়।
একই গ্রামের বাসিন্দা মো. আবু সায়িদের ছেলে শিশু মো. রুবেল। রুবেল বলে, আমরা গরির মানুষ। আমার আব্বা বুড়া (বৃদ্ধ) মানুষ। কোনো কাম (কাজ) করতে পারে না। এ জন্য আমি এখন ঘোড়া চালাই। এতে ৪০০-৫০০ টাকা রোজগার হয়। সেটা মা-বাপকে দিয়ে দেই।
মো. শামছু মিয়ার ছেলে শিশু মো. রিপন ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সেও ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে পর্যটকদের কাছে ঠান্ডা শরবত বিক্রি করছে। রিপন বলে, যেদিন মানুষ বেশি আসে সেদিন বেশি টাকা বিক্রি করতে পারি। সারা দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বিক্রি করতে পারি।
বিক্রি হওয়া টাকা কি করো এমন প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, সব টাকা মা-বাবার কাছে দেই। এই টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালাই।
সুনামগঞ্জ জজকোর্টের আইনজীবী মাহাবুবুল হাছান শাহীন ঢাকা পোস্টকে বললেন, মরমি কবি হাসন রাজা, আব্দুল করিম, দুর্বিনশাহ্, রাধারমন দত্তসহ অসংখ্য আউল বাউলের জেলা সুনামগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা পর্যটকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে হাওরপাড়ের শিশু সংগ্রামীরা। এতে করে তাদের কিছু আয়ও হচ্ছে। তবে মহামারি করোনার জন্য এখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এতে এসব শিশুদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদ্যালয় খুললে প্রশাসনকে এ বিষয়ে আরও তৎপর হতে হবে।
এসপি