ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি। নানা কারণে এর খ্যাতি রয়েছে। ঢাকার বাইরে প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র বাসভবন এটি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিঘাপতিয়ার এই রাজবাড়িকে ‘উত্তরা গণভবন’ নামকরণ করেন।

নিরাপত্তাজনিত কারণে উত্তরা গণভবনে জনসাধারণের প্রবেশ নিষেধ ছিল। স্থানীয় জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই প্রতিদিনি দূর-দূরান্ত থেকে মানুষের পদভারে মুখর হয়ে ওঠে উত্তরা গণভবন।

প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন উত্তরা গণভবনকে ঘিরে আগ্রহী মানুষ ভিড় জমায়। প্রতিদিন বহু নারী-পুরুষ আসেন এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি দেখতে।

উত্তরা গণভবন পর্যটকদের জন্য এক বিরাট আকর্ষণ। চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর। প্রাচীরের কোল ঘেঁষে ভেতরে ও বাইরে গভীর প্রশস্ত পরিখা। দ্বিতল সুউচ্চ প্রবেশপথের ওপর বিশাল মিনার। মিনারের চূড়ায় একটি বৃহৎ দেয়ালঘড়ি আজও টিকটিক করে চলছে। প্রতি ঘণ্টায় যার ধরাজধ্বনী বহুদূর থেকে শোনা যায়।

প্রবেশপথের দুই পাড়ে একাধিক কামান। ভেতরে ঢুকেই চোখে পড়ে দোল মঞ্চ, পারিজাত, কেয়া, কামিনি, হৈমন্তিকাসহ দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুল আর হরেক রকমের ফলদ-বনজ বৃক্ষরাজি। সাজানো গোছানো রাজবাড়ির একটু এগোতেই চোখে পড়ে কুমার ভবন, কৃত্রিম রাবারগাছ, ঝরনা আর শ্বেতপাথরে নারী মূর্তি। আছে কর্পূরগাছ। আরও আছে ৩০০ বছর আগের কাঠের তৈরি দামি আসবাবপত্র, ঝাড়বাতি, ফুলদানি, বিশাল হলরুম আরও কত কী, যেগুলো এখনো নষ্ট হয়নি। চোখে না দেখে যেন মন ভরে না।

জানা যায়, ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে দয়ারাম রায় নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে রাজবাড়িটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এরপর ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকোশলী, চিত্রশিল্পী ও কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল হিসেবে গড়ে ওঠে আজকের এই নয়নাভিরাম রাজপ্রাসাদ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হয়। এরপর প্রাসাদটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ১৯৬৬ সালে ইস্ট পাকিস্তান হাউস ও পরে ১৯৬৭ সালে গভর্নর হাউস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানে রাত্রিযাপন করেন এবং এটিকে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন হিসেবে উত্তরা গণভবন নামকরণ করেন।

দীর্ঘদিন ধরে সরকারি কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এই ঐতিহ্যবাহী ভবনটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশের সুযোগ সংকুচিত ছিল। ২০১২ সালে রাজবাড়িটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। তখন  প্রবেশমূল্য ছিল ১০ টাকা। এতে দর্শনার্থীরা রাজবাড়ির মাত্র ৩০ ভাগ এলাকা দেখতে পেতেন। পরে প্রবেশমূল্য বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয় ২০ টাকা। আর সর্বশেষ গত ৯ মার্চ রাজবাড়ির ট্রেজারি ভবনে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় সংগ্রহশালা। ওই দিন থেকেই সংগ্রহশালাটি দর্শনার্থীদের জন্য টিকিটের মাধ্যমে উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এ সময় গণভবনের ৮০ ভাগ এলাকা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়।

যা যা দেখবেন
নাটোর শহর থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ৪১ দশমিক ৫ একর জমির ওপর স্থাপিত গণভবনের প্রধান প্যালেস আর ইতালিয়ান গার্ডেনের মাঝের ভবনটিতে রয়েছে সংগ্রহশালা। ৩০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। রাজা-রানির ছবি, রাজকুমারী ইন্দুমতির নিজ হাতে লেখা ২৮৫টি চিঠি, রাজপরিবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রী, চাকাওয়ালা চেয়ার, টেবিল, সিংহাসন, দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের ইতিহাসের মতো ঐতিহাসিক সব নিদর্শন সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।

সংগ্রহশালার করিডোরে রয়েছে রাজা প্রমদানাথ রায় ও সস্ত্রীক রাজা দয়ারাম রায়ের ছবি। সঙ্গে রাজবাড়ির সংক্ষিপ্ত বিবরণ। রয়েছে মার্বেল পাথরের রাজকীয় বাথটাব। রাজার পালঙ্ক, ঘূর্ণমান চেয়ার, টেবিল, আরামচেয়ার আর ড্রেসিং টেবিল দিয়ে পাশের ঘরটি যেন রাজার শয়নকক্ষের প্রতিরূপ।

বাঁ পাশের দ্বিতীয় কক্ষে শোভা বাড়াচ্ছে রাজসিংহাসন, রাজার মুকুট আর রাজার গাউন। আরও আছে মার্বেল পাথরের থালা, বাটি, কাচের জার, পিতলের গোলাপ জলদানি আর চিনামাটির ডিনার সেট। এই কক্ষে রয়েছে রাজপরিবারের লাইব্রেরির বই আর শেষ রাজা প্রতিভা নাথ রায়ের ইনস্যুরেন্স বিষয়ক কাগজপত্র।

পাশের কক্ষটি রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা চৌধুরানির। এটি সুশোভিত বিভিন্ন সামগ্রীতে। ইন্দুপ্রভার একটি ছবি রাখা হয়েছে পিতলের একটি ফ্রেমে। আরও আছে তার ব্যক্তিগত ডায়েরি, আত্মজীবনী, পান্ডুলিপি, তার কাছে লেখা স্বামী মহেন্দ্রনাথ চৌধুরীর অগুনতি চিঠি। পাশেই রয়েছে চিঠিগুলো রাখার পিতলের সুটকেস। দর্শনার্থীদের জন্য ইন্দুপ্রভার লেখা ‘বঙ্গোপসাগর’ কবিতাটি ফ্রেমে বাঁধাই করে দেয়ালে টানানো হয়েছে। ৬৭ লাইনের এই কবিতায় তিনি বর্ণনা করেছেন বঙ্গোপসাগরের অপরূপ সৌন্দর্য।

এর বাইরেও সংগ্রহশালার ১০টি কক্ষের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে দিঘাপতিয়া রাজপরিবারের ব্যবহৃত দৃষ্টিনন্দন সব আসবাব। এর মধ্যে রয়েছে ডিম্বাকৃতি, গোলাকার, অষ্টভুজাকৃতি, চতুর্ভুজাকৃতি ছাড়াও দোতলা, প্রসাধনী ব্যবহারের উপযোগী ও কর্নার টেবিল। রয়েছে গার্ডেন ফ্যান-কাম-টি টেবিল।

নবসৌন্দর্যে বিমোহিত গণভবনের প্রধান প্যালেসের পাশের জলচৌকির আগাছাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে, পরিষ্কার করা হয়েছে ভেতরের আম-বাগানের আগাছাগুলোও। রাজপরিবারের সবজি বাগানটিকে ঘোষণা করা হয়েছে সাপের অভয়ারণ্য হিসেবে।

নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংস্কারসহ সংগ্রহশালা, চিড়িয়াখানা ও পাখির অভয়াশ্রম গড়ে তোলায় গণভবনে দর্শনার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। মূল ফটকে প্রবেশমূল্য ১০ থেকে ২০ টাকা আর সংগ্রহশালায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের প্রবেশাধিকার থাকে। সপ্তাহে অন্তত ৫০ হাজার দর্শনার্থী গণভবন দেখতে আসেন।

উত্তরা গণভবনে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ করতে হবে বলে জানান জেলা প্রশাসক।

এনএ