গ্রামবাংলার নদী-নালা, ও খাল-বিলে ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরার দৃশ্যটি বেশ চিরচেনা। সকাল-দুপর-বিকেল শিকারির পায়ের চাপে জাল ওপরে উঠত। চিংড়ি, টেংরা, পুঁটি, বাইলা, বাইমসহ নানা প্রজাতির দেশি মাছের তড়পানোর দৃশ্য ছিল মনলোভা। ভোজনরসিকদের এসব মাছ দেখে লোভ সামলানো কঠিন হতো। মাছশিকারিও মাছ বিক্রি করে সে আয় দিয়ে পরিবারের খরচ জোগাতেন।

তবে সেই অপরূপ দৃশ্য এখন খুব একটা চোখে পড়ে না। কারণ কালের বিবর্তন আর দেশি মাছের প্রজনন কমে যাওয়ায় তা এখন বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামের হাওর-বাঁওড়, বিল ও প্রাকৃতিক জলাশয়ে ২০-২৫ বছর আগেও বছরজুড়েই ভেসাল দিয়ে মাছ ধরা হতো। আবার শুষ্ক মৌসুমে খাল-বিলে পানি না থাকায় তা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

জানা যায়, মাছ ধরার ভেসাল বেয়াল জাল নামেও পরিচিত। এটি এমন একটি মাছ ধরার পদ্ধতি, যা পানির একটি নির্দিষ্ট গভীরতা পর্যন্ত ডুবিয়ে দেওয়া হয়। তারপর মাছ প্রবেশ করলে উত্তোলন করে মাছ ধরা হয়। ভেসাল জালগুলো অনেক সমতল বা থলে আকৃতির, আয়তক্ষেত্র, পিরামিড বা শঙ্কুর মতো হতে পারে। এ জাল জেলে তার হাত দিয়ে পরিচালনা করে। এটি কখনো নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে কিংবা নৌকা দিয়েও পরিচালনা করা যায়।

ভেসাল জাল কখনো কখনো 'গভীর জাল' নামেও পরিচিত হয়, যদিও এ শব্দটি হাতজাল বলেও ডাকা হয়। ভেসাল জাল বানাতে বাঁশ ও জাল তৈরির উপযোগী শক্ত সুতা ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ত্রিভুজাকৃতির একটি লম্বা বাঁশের ফ্রেম থাকে। এ ফ্রেম জুড়ে জাল সংযুক্ত করা হয়।

ভেসাল দিয়ে মাছ শিকারের দারুণ এ কৌশল চোখে পড়ে বালিয়াকান্দি উপজেলার বহরপুর ইউনিয়নের আবাসন (গুচ্ছ গ্রাম) এলাকার ছোট ছোট বদ্ধ খাল-বিলগুলোতে। এ সময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পরিবেশে ভেসাল ফেলে বসে থাকতে দেখা যায় পরান হালদারকে। কিছুক্ষণ পরপর জাল তুলে আটকা পড়া মাছগুলো ঝাঁকাতে সংরক্ষণ করছেন।

একফাঁকে কথা হয় তার সাথে। ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্ষা মৌসুম এলেই বারুগ্রামের খাল-বিল গুলোতে পানি ভরপুর থাকে। এ সময় এখানে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। প্রতিবছরই আমি এই বারুগ্রামে বর্ষা মৌসুম এলেই ভেসাল পাতি। মাঝেমধ্যে রাত জেগেও ভেসাল পাহারা দেই। ভেসাল ফেলে অনেক ছোট মাছ পাই। মাঝেমধ্যে কিছু বড় মাছও মেলে। সেগুলো দিন শেষে বিক্রি করে বাড়ি ফিরি। যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চালাই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাছ ধরার এই অভিনব কৌশল নদীতে ব্যবহার করলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মৎস্যসম্পদ। বিভিন্ন বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছও আটকা পরে এই জালে। মাছের রেণুও এই জালে ধরা পরায় মাছের প্রজনন ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটে।

মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০-এ বলা হয়েছে, চাষের উদ্দেশ্য ব্যতীত কেউ প্রতিবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর (আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি থেকে পৌষ মাসের মাঝামাঝি) পর্যন্ত ২৩ সেন্টিমিটারের (৯ ইঞ্চি) নিচে থাকা কাতলা, রুই, মৃগেল, কালবাউশ, ঘনিয়াসহ দেশি প্রজাতির মাছ নিধন করতে পারবে না।

চাষের উদ্দেশ্যে মাছ ধরতেও জেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। অন্যদিকে, মাছ ধরার ক্ষেত্রে ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার বা তার চেয়ে কম ফাঁসবিশিষ্ট জাল ব্যবহার করা যাবে না। আইন অমান্য করলে এক মাস থেকে সর্বোচ্চ এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রয়েছে।

অনেকেই জানান, এখন নদী-নালা, খাল-বিলে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আগে উন্মুক্ত জলাশয়ে, কই, শিং, মাগুর, সরপুঁটি, বাতাসি, টাকিসহ নানা প্রকার মাছ পাওয়া যেত। এ ছাড়া নদী-খাল-পুকুরে বড় মাছের মধ্যে রুই-কাতল-মৃগেল, কালিবাউশ, আইড়, শোল, বোয়াল পাওয়া যেত।

বারুগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক মুন্সি আমীর আলী বলেন, তার খাল-বিলগুলোয় ভেসাল জাল পেতে দেশি জাতের মাছ শিকার করতে আগে দেখা যেত। তবে কালের পরিক্রমায় এখন আর তার দেখা মেলে না। অল্প দামে বেশি প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে ভেসালের ভূমিকা অনবদ্য। অনেক মানুষই তাদের পরিবারের আমিষের চাহিদা মেটাতে পারে এই মাধ্যম দিয়ে।

রাজবাড়ী সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মো. আরিফুর ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবহমান গ্রাম-বাংলার রূপের মধ্যে ভেসাল জাল অন্যতম। বাংলার পথঘাট দিয়ে পূর্বে হেঁটে যেতে চোখে পড়ত অনেক ভেসাল জাল। কিন্তু এখন তা দেখতে পাওয়া যায় না। কারণ নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট হয়ে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে উঠেছে। ফলে অনেক দেশি প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পথে। আর খাল-বিলে মাছের পরিমাণ কমাতে এই মাছ ধরার বিশেষ ফাঁদ ‘ভেসাল’ জাল এখন বিলুপ্তির পথে।

জেলা মৎস কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) রোকনুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদ-নদী, খাল-বিলগুলো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় প্রচুর দেশীয় প্রজাতির মাছের দেখা মিলছে এসব ক্ষেত্র থেকে। মৎস্য আইন অনুযায়ী উন্মুক্ত জলাশয়ে, খাল-বিলে মাছ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা, নদী বা খালে কোনো কিছু দিয়ে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া, যেকোনো ধরনের ফাঁদ ব্যবহার ও স্থাপনা নির্মাণ এবং ভেসাল জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ।

মীর সামসুজ্জামান/এনএ