মর্গ যখন নিজেই লাশ!
ঠাকুরগাঁওয়ের মর্গের করুণ অবস্থা
মাঝে একটি ঘর। চারদিকে জঙ্গল। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরেই রয়েছে একটি মর্গ (লাশকাটা ঘর)। যেখানে কাটা হয় মরদেহ। এমনই একটি মর্গ রয়েছে ঠাকুরগাঁও সদরে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত সংস্কার হয়নি এই মর্গের। মর্গ নিজেই যেন লাশ হয়ে পড়ে রয়েছে। আধুনিক এই যুগেও এখনো হাতুড়ি, বাটাল আর করাত ও ছেনি ব্যবহার করে কাটা হয় মরদেহ।
মর্গ মানেই গা-ছমছম ব্যাপার। তার ওপর এর পারিপার্শ্বিক অবস্থা যদি আরও ভীতিকর হয়, তাহলে তো এর ভেতরে যাওয়ার কথা ভাবাও মুশকিল। দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার ও আধুনিকায়ন না করায় অযত্নে-অবহেলায় আজ এটি নিজেই লাশ হয়ে রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিন ১৯ জানুয়ারি সকালে ঠিক এমনই চিত্র চোখে পড়ে। জেলার আধুনিক সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন জঙ্গলের ভেতরে এর অবস্থান। এখানে না আছে পর্যাপ্ত আলো, না আছে আধুনিক কোনো যন্ত্রপাতি। পানিরও কোনো ব্যবস্থা নেই। পাশের নদী থেকে পানি এনে যাবতীয় কাজ করেন এখানে কর্মরত দুজন।
১৯৭৮ সালে সদর হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। সেই সময়ে শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে নদীর পাশে নির্মাণ করা হয় এ মর্গটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাসপাতালটি কয়েক দফায় সংস্কার করে আধুনিকায়ন করা হলেও সংস্কার হয়নি মর্গটির। সংস্কার বা আধুনিক করার কোনো প্রদক্ষেপ না নেওয়ায় মর্গে এখনো হাতুড়ি ও বাটাল দিয়ে মরদেহ কাটার কাজ করা হয়। জেলার পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় এই মর্গে। ডিএনএ নমুনা সংগ্রহে রাখার জন্য নেই কোনো আধুনিক ব্যবস্থা। প্লাস্টিকের কৌটায় নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়।
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে ময়নাতদন্তের জন্য পুরুষ ও নারী ডোম রাখার নিয়ম থাকলেও এ মর্গে শুধু একজন পুরুষ ডোমই কর্মরত আছেন। নিজস্ব কোনো ল্যাবরেটরি না থাকায় ঢাকার মহাখালী জনস্বাস্থ্যে কেন্দ্রে মরদেহের ভিসেরা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয় ভিসেরা প্রতিবেদনের জন্য। সে জন্য অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন তাৎক্ষণিক দেওয়ার নিয়ম থাকলেও দেওয়া হয় দেরিতে।
স্থানীয় জামাল হোসেন নামের একজন বলেন, এ জেলায় একজন ডোম রয়েছেন। তিনি কখনো অসুস্থ হয়ে পড়লে বিকল্প নেই। আর আধুনিক যুগেও এখানে হাতুড়ি-বাটাল-করাত দিয়ে মরদেহ কাটা হয়। এ মর্গটি যেন আধুনিক করা হয়, কর্তৃপক্ষের আছে আবেদন জানাই। নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ডোম রাখা উচিত।
সদর হাসপাতাল থেকে মর্গটি অনেক দূরে। বর্তমানে এটির বেহাল। এটিকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সঙ্গে নতুন লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। আশা করি মর্গটি সংস্কার করা হবে দ্রুত।
রাকিবুল আলম চয়ন, আবাসিক চিকিৎসক, ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতাল
কথা হয় জোছনা খাতুন নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, মর্গ যেটি রয়েছে এখানে, মাত্র একজন পুরুষ ডোম রয়েছেন। এখানে কোনো নারীর ময়নাতন্ত করার জন্য লাশ নিলে পুরুষ ডোম তা করেন। কোনো নারী মারা যাওয়ার পর যদি পুরুষ ডোম সেটি কাটাছেঁড়া করেন, এতে মৃত্যুর পরও সেই নারীর সম্মানহানি হয়। দ্রুত একজন নারী ডোম রাখার দাবি জানান তিনি।
মর্গের ডোম শুকুমার দাস বলেন, সারাদেশে মর্গ স্থাপন করা হয়েছে আধুনিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে। এখানে আধুনিকায়ন না হওয়ায় নিয়ম মোতাবেক লাশ ময়নাতদন্ত করা সম্ভব হয় না। এভাবে লাশের শরীরের বিভিন্ন আলামত নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। মরদেহ কাটার পরে নদী থেকে পানি এনে পরিষ্কার করতে হয়। মর্গে আলামত রক্ষাকারী বাক্স না থাকায় তা সংরক্ষণ করা ঝুঁকি।
ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক রাকিবুল আলম চয়ন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সদর হাসপাতাল থেকে মর্গটি অনেক দূরে। বর্তমানে এটির বেহাল। এটিকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। সঙ্গে নতুন লোকবল নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে। আশা করি মর্গটি সংস্কার করা হবে দ্রুত।
এনএ