৯ সন্তানের জনক আফাজ উদ্দিন মোল্লা ওরফে আফু মোল্লার বয়স ১০৪ বছর। তার স্ত্রী রেশপতি বেগম ৯৫ ছুঁইছুঁই। বয়সের ভারে দুজনেই নুয়ে পড়েছেন। আফু মোল্লা ৩০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন। কয়েক বছর আগে তার তিন ছেলে কৌশলে তার কাছ থেকে সব জমি নিজেদের ও স্ত্রীদের নামে লিখে নিয়েছেন। আর তাতেই বাকি সন্তানরা ক্ষুব্ধ হয়ে বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেন। তাই পাড়া-প্রতিবেশীদের দয়ায় কোনোমতে বেঁচে আছেন তারা।

আফাজ উদ্দিন মোল্লা চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার জেহালা ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের মৃত হুজুর আলী মোল্লার ছেলে।

বিষয়টি জানতে পেরে চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) তাদের বাড়িতে ছুটে যান। এ সময় তিনি দুই মাসের ভরণপোষণসহ নতুন পোশাক, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, চিকিৎসার ওষুধসহ অর্থ প্রদান করেন অসহায় আফু-রেশপতি দম্পতির হাতে। এ সময় পুলিশ সুপারকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।

স্থানীয়রা জানান, আফাজ উদ্দিন মোল্লার দুই ছেলেসন্তান শমসের আলী মোল্লা ও আরজুল্লাহ মোল্লাকে রেখে প্রথম স্ত্রী মারা যান। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রী রেশপতি বেগমের ঘরে আসে পরপর সাত সন্তান। তাদের মধ্যে চার মেয়ে, তিন ছেলে। বছর তিনেক আগে রেশপতি বেগম পক্ষাঘাতগ্রস্ত (প্যারালাইজড) হয়ে শয্যাশায়ী হন। আর আফু মোল্লাও বয়সের ভারে চলাচল করতে পারেন না। 

দ্বিতীয় স্ত্রীর তিন ছেলেসন্তান শহিদ মোল্লা, হাবিবুল মোল্লা ও মেহেদুল মোল্লা বেশ সম্পদশালী। কিন্তু প্রথমপক্ষের দুজন এবং দ্বিতীয়পক্ষের অন্য সন্তানরা কোনো রকম জীবন যাপন করছেন। কয়েক বছর আগে শহিদ মোল্লা, হাবিবুল মোল্লা ও মেহেদুল মোল্লা বাবার কাছ থেকে কৌশলে ৩০ বিঘা জমি তাদের নিজ ও স্ত্রীদের নামে লিখে নেন। কিন্তু ভরণপোষণের দায়িত্ব নেননি। আর ক্ষোভে অন্য সন্তানরাও মা-বাবাকে দেখাশোনা বন্ধ করে দেন। তাই বৃদ্ধ দম্পতি ঠাঁই হয় ছেলে শহীদ মোল্লার রাস্তার ধারের একটি টিনশেড ঘরে। কিন্তু পুত্রবধূ বা নাতি-নাতনিরাও খোঁজ নেয় না তাদের।

বছর দুয়েক আগে শহীদ মোল্লা মারা যান। অন্য দুই সন্তান প্রবাসী। তাদের মধ্যে হাবিবুল মোল্লা থাকেন ইতালি, মেহেদুল মোল্লা থাকে কুয়েতে। 

সরেজমিনে দেখা যায় বৃদ্ধা রেশপতি বেগম বিছানায় পড়ে আছেন। তার বাঁ দিকটা অচল। ঘরের এ-মাথা ও-মাথা গড়িয়ে গড়িয়ে চলেন। আফু মোল্লা নিজে কোনোরকম চলাচল করলেও তিনিই এখন স্ত্রীর একমাত্র সেকব।

আফু মোল্লা কেঁদে কেঁদে বলেন, আমার তিন ছেলেই বড়লোক। বাকিগুলোর কোনোরকম টেনেটুনে সংসার চলে। তারা বড় বড় বাড়ির মালিক। তারা আমার কাছ থেকে কৌশলে জমিজমা সব লিখে নিয়েছে। এখন আমাদের কোনো খোঁজ নেয় না। অন্য ছেলে-মেয়েও আমাদের দেখে না। কী যে যন্ত্রণায় আছি তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আগে কোনো কোনো বিটার বউ (পুত্রবধূ) এক-আধটু খেতে দিত। এখন তাও দেয় না। আমাদের দুর্দশা দেখে প্রতিবেশীরা খাবার দিয়ে যায়। কিন্তু এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়?

স্থানীয় ইউপি সদস্য ওহিদ আলী বলেন, আফু মোল্লা ও তার স্ত্রী রেশপতি বেগম খুব অসহায়ভাবে জীবন যাপন করছেন। সন্তানরা তাদের দেখাশোনা তো দূরের কথা, দুবেলা খাবারও দিচ্ছে না। আফু মোল্লার তিন ছেলে দুর্নীতি করে জমিজমা লিখে নিয়েছে। তারা দেশের বাইরে থাকে। কিন্তু তাদের স্ত্রীরাও বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কোনো খোঁজখবর রাখে না।

আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রনি আলম নূর বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। ছেলেরা যদি জোরপূর্বক জমি লিখে নিয়ে থাকে, তালে ওই দম্পতি অভিযোগ করলে আমরা বিষয়টি দেখব। আর যদি কোনো অভিযোগ না থাকে, তাহলে আমরা সরকারিভাবে কোনো ঘর কিংবা তার ছেলেদের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করব।

চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, বৃদ্ধ আফু মোল্লার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেরা কৌশলে তার সম্পত্তি লিখে নেওয়ার পর অন্য সন্তানরা ক্ষুব্ধ হয়ে বাবা-মায়ের খোঁজখবর নেওয়া বন্ধ করে দেয়। ফলে আফু মোল্লা ও তার স্ত্রী রেশপতি বেগম পড়েন বিপদে। তারা একটি টিনশেড ঘরে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। বছর তিনেক আগে রেশপতি বেগম প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী অবস্থায় আছেন। বর্তমানে কোনো পক্ষের সন্তানই তাদের খোঁজখবর নেয় না। খবর পেয়ে আমি এই দম্পতির করুণ অবস্থা দেখে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু সহযোগিতা করেছি।

তিনি আরও বলেন, চুয়াডাঙ্গাবাসীর যেকোনো প্রয়োজনে আমার অফিস ২৪ ঘণ্টা খোলা। তিনি সমাজের সর্বস্তরের সামর্থ্যবান মানুষকে অসহায় সুবিধাবঞ্চিতদের দিকে একটু সুদৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান জানান।

আফজালুল হক/এনএ