দেশের ছয়টি চিনিকল বন্ধের প্রভাব পড়েছে আখচাষিদের ওপর। মিল বন্ধ থাকায় উৎপাদিত আখ সরবরাহ করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। বাধ্য হয়েই বিভিন্ন হাট-বাজারে অল্প দামে বিক্রি করছেন তারা।

মিল বন্ধ থাকায় এ বছর পাবনা চিনিকল এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত আখ সরবরাহের দায়িত্ব নেবে না বলে জানিয়েছে চিনিকল কর্তৃপক্ষ। আর পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলে গত বছর কৃষকরা আখ সরবরাহ করতে পারলেও এ বছর এখনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাননি। ফলে উৎপাদিত আখ এখন চাষিদের গলার কাটায় পরিণত হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পাবনা জেলার মিল জোন এবং নন-মিল জোন মিলে আখ চাষ হয়েছিল ৩ হাজার ২৯৯ হেক্টর জমিতে। মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ ঘোষণার পর ২০২১-২২ অর্থবছরে জেলায় মোট ১ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে আখ আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন হয়েছিল ২ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৬ মেট্রিক টন। 

মিল কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে আখ মাড়াই স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এই মৌসুমে মিল জোন থেকে প্রায় ৩০ হাজার টন আখ পার্শ্ববর্তী মিলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এর আগে ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে পাবনা সুগার মিলে ১ লাখ টন আখ মাড়াই করা হয়েছিল।

পাবনা সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন বলেন, পাবনা চিনিকলের অন্তর্গত ১০টি চিনি উৎপাদনের জোন আছে। তবে উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর মিলের নিকটবর্তী চারটি আখ উৎপাদন জোনকে পাবনার নিকটবর্তী গোপালপুর চিনিকলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কৃষকদের আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। 

যে চারটি জোন নাটোরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে সেগুলো হলো- ঈশ্বরদী জোন, মুলাডুলি জোন, লক্ষ্মীকুন্ডা জোন ও মিলগেট জোন। এসব জোনের আওতাধীন কৃষকরা নির্ধারিত সময়ে আখ সরবরাহ করতে পারবেন বলে জানান তিনি।

পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী দিলু জানান, তিনি গত বছর আটঘরিয়ায় ২৮ বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেছিলেন। মিল বন্ধ ঘোষণার পর উৎপাদিত আখ নিয়ে অনেক ভোগান্তি হয়েছে। শেষমেষ নাটোরের চিনিকলে সরবরাহ করেছিলেন।

আনসার আলী বলেন, এ বছর মাত্র ১৪ বিঘা জমিতে আখ আবাদ করেছেন। বাকি জমি অন্য কৃষকদের কাছে লিজ দিয়েছেন। এ কারণে এ বছর তিনি লোকসানে পড়েছেন। এক বিঘা জমিতে আখের আবাদ করে ৫০-৬০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।

সদরের আশুতোষপুর এলাকার চাষি দিরাজ মন্ডল জানান, গত বছর ছয় বিঘা জমিতে আখের আবাদ করেছিলেন। মিল থেকে এ বছর কৃষকদের সার, বীজ, কীটনাশক ও নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়নি। তাই তিনি আঁখের আবাদ না করে পেঁয়াজের আবাদ করেছেন।

আখচাষি হারেজ আলী বলেন, এই বছর পাঁচ বিঘা জমিতে আখ উৎপাদন করেছি। আশা করেছিলাম মিলে আখ সরবরাহ করতে পারব। মিল থেকে আখ নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বাধ্য হয়েই আমরা আখ মাড়াই করে গুড় তৈরি করছি। মিল চালু থাকলে আমরা অনেক লাভবান হতাম।

পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন জানান, গত বছর থেকে দেশের ছয়টি সুগার মিল বন্ধ রয়েছে। ফলে কৃষকদের ঋণ দেওয়াও বন্ধ রাখা হয়েছে। চিনির উৎপাদন বন্ধ থাকায় কৃষকদের কাছ থেকে টাকা ফেরত না পাওয়ায় ঋণ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। মিল বন্ধ থাকায় আখের উৎপাদনও কম হয়েছে।

জানা যায়, গত বছর শিল্প মন্ত্রণালয়ের ১১৬ নম্বর স্মারকের এক চিঠিতে বলা হয়, চিনি আহরণের হার, আখের জমি, মিলের অবস্থা, লোকসানের পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনার খরচ বিবেচনা করে দেশের ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টিতে আখ মাড়াই না করতে প্রস্তাব করা হয়। অধিকতর বিবেচনায় ৯টি চিনিকলে আখ মাড়াইয়ের সুপারিশ করা হয়েছে। আদেশ জারির পর ২০২০ সাল থেকে পাবনা চিনিকল, কুষ্টিয়া চিনিকল, রংপুর চিনিকল, পঞ্চগড় চিনিকল, শ্যামপুর চিনিকল, সেতাবগঞ্জ চিনিকলের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সরেজমিনে দেখা যায়, গত মৌসুম থেকে পাবনা চিনিকলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে পাবনা সুগার মিলের শতাধিক কোটি টাকার সম্পদ। পরিচর্যার অভাবে মিলের পুরো এলাকা আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মিলের যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরে সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। দ্রুত মিল চালু করা না গেলে মিলের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন মিলের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কৃষকরা। কৃষকদের স্বার্থে মিলের উৎপাদন পুনরায় চালু করার দাবি করেন তারা।

পাবনা সুগার মিলের আখচাষি সমিতির সভাপতি শাজাহান আলী পেঁপে বাদশা বলেন, কৃষকদের স্বার্থে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য বন্ধ মিল চালু রাখা দরকার। বন্ধ মিল চালু করা না হলে এসব মিলের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন করবে না। পাশাপাশি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকায় বন্ধ মিলের শত কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। এতে সরকারও লোকসানে পড়বে।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিনিকল বন্ধ থাকলেও আখচাষিদের তেমন ক্ষতি হবে না। কৃষকদের আখ উৎপাদন অব্যাহত রাখতে বলা হয়েছে। আখ দিয়ে গুড় বানিয়ে বাজারজাত করতে বলা হচ্ছে। কারণ বাজারে গুড়ের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়েছে। গুড়ের কারখানা তৈরি করতে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে চিনিকলটি চালু হলে সবার জন্য ভালো হবে।

রাকিব হাসনাত/এসপি