পানির তোড়ে বসতভিটা ভেঙে চলে যাচ্ছে, তা বসে দেখা ছাড়া আর কিছু নাই তাদের

ভারত গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় উজান থেকে আসা ঢলে তিস্তা নদী এখন পানিতে টইটম্বুর। এতে রংপুরে তিস্তাতীরবর্তী চরের প্লাবিত নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। জেলার তিস্তা নদীবেষ্টিত গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। নদীতীরবর্তী এলাকায় আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে। তবে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) সকাল থেকে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে বইছে।

আকস্মিক এ বন্যায় তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, আবাদি জমিসহ ধান, আলু, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের খেত। পানির তীব্র স্রোতে নদীভাঙনের সঙ্গে দেখা দিয়েছে সড়কপথেও ভাঙন।

ইতোমধ্যে রংপুর-লালমনিরহাট জেলার আঞ্চলিক সড়কের একটি অংশ ধসে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর থেকে লালমিনরহাটের কালীগঞ্জ কাকিনা পর্যন্ত সড়কপথে যোগাযোগ। এ ছাড়া বিভিন্ন চর এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে।

বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) সকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গঙ্গাচড়া উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় অনেকেই উঁচু স্থানে ও বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছেন। কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চরঢুষমারা, গদাই, পাঞ্জারভাঙ্গাসহ বেশ কিছু তিস্তা নদীতীরবর্তী গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে সেখানকার অন্তত দুই হাজার বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। একই চিত্র পীরগাছা উপজেলায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রংপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, দেশের উজানে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখান থেকে ভাটির দিকে ধেয়ে আসা পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সব কটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

এদিকে তিস্তায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে ঘরবাড়ি, গাছগাছালিসহ বসতভিটা। পানিবন্দী এলাকায় অনেকই গবাদিপশু ও ঘরের আসবাব নিয়ে রাস্তায় ও উঁচু স্থানে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছেন। কেউবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় ভাসছেন। আবার কেউ কেউ উঁচু স্থানে পরিবার নিয়ে অবস্থান করছেন। গঙ্গাচড়ার আলমবিদিতর, লক্ষ্মীটারী, কোলকোন্দ, নোহালী ও গজঘণ্টা ইউনিয়নের অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরইশরকুল, ইছলি, পূর্ব ইছলি, পশ্চিম ইছলি ও শংকর, বাগেরহাট, কেল্লারহাটসহ বেশ কিছু গ্রামের তিন থেকে চার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। তবে অনেকেই পানির মধ্যে অবস্থান করছে। এই এলাকার রান্নাঘর, আঙিনাসহ ঘরে কোথাও কোমরসমান, কোথাও হাঁটুপানি। কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, উত্তর চিলাখাল, সাউথপাড়া, মটুকপুরসহ আশপাশের গ্রামগুলোতেও হু হু করে পানি বাড়ছে। কমপক্ষে দুই হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

নোহালী ইউনিয়নের নোহালী, চর নোহালী, বাগডোহরা, মিনার বাজার, চর বাগডোহরা ও নোহালী সাপমারী, আলমবিদিতর ইউনিয়নের হাজীপাড়া ও ব্যাংকপাড়া, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল, উত্তর চিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনা মাঝের চর, সাউদপাড়া ও বাবুরটারী, বাঁধেরপাড়, গজঘন্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, গাউছিয়া, জয়দেব, রমাকান্ত, একনাথ ও কালির চর এবং মর্নেয়া ইউনিয়নের আলাল চর, তালপট্টি চর, হাজিরপাড়া, নরসিংহ ও মর্নেয়া চর এলাকায় আরও প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যানরা।

এদিকে নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের পানিবন্দী পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। পানিবন্দী লোকজনের মধ্যে দেখা দিয়েছে শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। বন্যায় চরাঞ্চলের সবজিসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা। অনেকের ফসল এরই মধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে।

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরইশরকুল গ্রামের কৃষক ফয়জুল মিয়া বলেন, হামার এত্তি হঠাৎ নদীত পানি বাড়ছে। মঙ্গলবার আইত (রাত) থাকি হু হু করি পানি ঢুকি হামার সোগে তলে গেইছে। সেদিন সারা আইত (রাত) ছাওয়াপোয়া নিয়্যা চৌকির ওপর বসি থাকা লাগছে। পরের দিন বাড়ি ছাড়িয়া বাঁধোত চলি আসছি। অসময়ে এই বানোত হামরা ফির ক্ষতির শিকার হইনো বাহে।

একই গ্রামের আবদুল মতিন বলেন, পানিত বন্দী হয়া খুব কষ্টোত আছি। শুকনা জায়গাও নাই যে সেটে উঠমো। কি খামো, কোটে যামো, ভাবি পাওচি না। এ্যালাও হামার খোঁজখবর নেবার জনতে কায়ো আইসে নাই। সারা বছর হামার কষ্ট লাগি থাকে। এমন হঠাৎ করি অসময়ে ভারত পানি ছাড়লে হামাক তো ডুবি মরা লাগবে।

বুধবার রাতে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি নদীভাঙন রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি পানিবন্দী মানুষদের মাঝে শুকনা খাবার ও ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন।

কোলেকান্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রাজু জানান, শুধু তার ইউনিয়নে ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পানি কিছুটা কমেছে। এখন ভাঙন দেখা দেওয়ায় লোকজন আতঙ্কে আছেন। পানিবন্দী মানুষকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বরাদ্দ শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। তালিকা করে চালও দেওয়া হবে।

লক্ষ্মীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকজনদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়েছে। এবারের ভয়াবহ বন্যায় আমার এলাকার তিস্তার চরাঞ্চলে প্রায় ৪ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। তবে আরও দ্রুত ত্রাণ প্রয়োজন।

তিস্তায় পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যার বিষয়টি নিশ্চিত করে রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. জাকারিয়া বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।

ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদ্দৌলা প্রিন্স ঢাকা পোস্টকে বলেন, টানা বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদী বেড়েছে। বন্যার পানি সামাল দিতে ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট (জলকপাট) খুলে রাখা হয়েছে। আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি। বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর রাখছি। তিস্তা অববাহিকায় রেড অ্যালার্ট জারি করে মানুষজনকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পানি কমতে শুরু করেছে। বর্তমানে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।

এনএ