বরেন্দ্র বলতে মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে রোদে পোড়া খাঁ খাঁ মাঠ, ছায়াহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মাঝেমধ্যে মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ। আর এর ডালে বাতাসে হেলান দিয়ে কারিগর বাবুই বুনে যায় বাসা। 

যুগে যুগে বাঙালি জীবন ও সাহিত্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে তালগাছ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক পায়ে দাঁড়ানো তালগাছকে দেখেছেন আকাশে উঁকি দিতে। আর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তালগাছকে পেয়েছেন নিজের মতো ঝাঁকড়াচুলো ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ছাত্র হিসেবে।

গ্রামগঞ্জের পুকুরপাড়ে সারি সারি তালগাছ ঘিরে ভূত-প্রেতের বাস। সেই বিশ্বাস থেকে ডালপালা মেলেছে নানা ধরনের কল্পকাহিনি। শিশুদের ছড়া-কবিতায়ও তালগাছ পড়ার উপজীব্য। কিন্তু কালক্রমে প্রকৃতি থেকে প্রায়ই হারিয়ে যেতে বসেছে তালগাছ। এই গাছ যে ব্যবহারিক জীবনের অংশ, সেটি টের পান বরেন্দ্রভূমির অধিবাসীরা।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এই তালগাছ ফেরানোর উদ্যোগ নেয়। প্রতিষ্ঠার তিন যুগে প্রতিবছরই তালবীজ রোপণ করে যাচ্ছে বিশেষায়িত এ সংস্থাটি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কর্মসূচি বরেন্দ্র এলাকায় তালবীজ রোপণের অংশ হিসেবেও রোপণ করা হয় তালবীজ। এককথায় বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে ফিরে এসেছে তালগাছের ঐতিহ্য।

বিএমডিএ সূত্র জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বরেন্দ্র অঞ্চলে ব্যাপক হারে তালবীজ রোপণ শুরু করে বিএমডিএ। ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ লাখ তালবীজ রোপণ করেছে সংস্থাটি। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। পরিবেশ সুরক্ষা ছাড়াও বজ্রপাত নিরোধ ছিল এই উদ্যোগের অন্যতম উদ্দেশ্য।

বরেন্দ্র অঞ্চলের রাস্তা ও খালের ধারে, সরকারি পুকুর এমনকি পতিত জমিতে যে সারি সারি তালগাছ দৃশ্যমান, তা ওই সময়কালে রোপণ করা। এসব তালগাছের কোথাও কোথাও ফল আসতে শুরু করেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা তালগাছ থেকে পাচ্ছে নানা সুবিধাও। সর্বশেষ বিশেষ কর্মসূচির আওতায় রোপণ করা হয়েছে আরও ২০ লাখ তালবীজ। তা থেকে ১২ লাখের ওপরে পাওয়া গেছে চারা। এই কর্মসূচিতে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।

এদিকে তালের যে উচ্চ পুষ্টিগুণ রয়েছে, তা অনেকেরই অজানা। মানবদেহের উপযোগী বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন ও মিনারেলস ছাড়াও অন্য ফলের তুলনায় তাল ফলে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ, আঁশ ও ক্যালরির উপস্থিতি অনেক বেশি। তালের রস আমাশয়, পেটের প্রদাহ ও কোষ্ঠকাঠিন্য নিরসনে সহায়ক এবং মূত্রের প্রবাহ বৃদ্ধিকারক হিসেবে কাজ করে।

এ ফলের রস শরীরকে ঠান্ডা রাখে, ক্লান্তি দূর করে, শরীরে শক্তি জোগায় এবং অনিদ্রা দূর করে। তালের রস থেকে তৈরি তালমিছরি সর্দি-কাশি নিবারণে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া যকৃতের পীড়া ও পিত্তনাশক হিসেবেও তাল বেশ কার্যকর। শিকড়ের নির্যাস শ্বাসতন্ত্র ও বাকলের নির্যাস দাঁতের সমস্যায় উপকারী।

বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহীর তানোর পৌর এলাকার বাসিন্দা আমিরুল ইসলাম পেষায় কৃষক। তানোর-মুণ্ডুমালা সড়ক ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। পৌর এলাকায় প্রবেশের আগেই রাস্তার দুধারে তালগাছের সারি। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি জানান, ২০ বছর আগেও রাস্তার দুধার বৃক্ষশূন্য ছিল। ক্ষেতের কাজে গিয়ে কৃষক-শ্রমিক প্রখর রোদে পুড়তেন। একটা সময় তালগাছ লাগায় বিএমডিএ। এখন এসব তালগাছে তাল ধরছে। লোকজন ছায়া ও জ্বালানি দুটোই পাচ্ছে। কচি তালের শ্বাস আবার পাকা তালের পিঠা পাওয়া যাচ্ছে।

একই ভাষ্য তানোরের বিলকুমারী পাড়ের গুবিরপাড়ার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিলপাড়ের রাস্তাটি ভেঙে যাচ্ছিল। কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছিল না। সাত-আট বছর আগে বিএমডিএ রাস্তার ধারে তালবীজ রোপণ করে। এরপর থেকে আর ভাঙেনি রাস্তা। গাছগুলো ছোট হওয়ায় লোকজন পাতা কেটে নিয়ে গিয়ে পাখা বানান। অনেকেই আবার তালপাতা নিয়ে গিয়ে ছউনি বানান। বড় হলে ফল ও কাঠ দুটোই পাওয়া যাবে।

এককথায় তালগাছের কোনো কিছুই ফেলনা নয় বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন খান।  তিনি বলেন, তালপাতা থেকে পাখা, বাঁশি, খেলনা, ঝুড়ি, মাদুর ছাড়াও ঘরের ছাউনি তৈরি হয়। ডালের আঁশ দিয়ে রশি, ব্রাশ, ফুলের টপ, বাজারের থলে ও টুপিসহ নানা পণ্য তৈরি হয়। অপেক্ষাকৃত শক্ত, মজবুত ও টেকসই তালকাঠ ঘরের খুঁটি, আসবাবপত্র, গৃহস্থালী সামগ্রী, শৌখিন দ্রব্য ও নৌকা তৈরিতে অনন্য। গ্রামগঞ্জে টিনের বা আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে দীর্ঘস্থায়ী তালকাঠ অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

একটি খেজুরগাছের চেয়ে তালগাছে অধিক পরিমাণ রস ও গুড় পাওয়া যায়। তা ছাড়া তালের রস সুস্বাদু পানীয় হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এই রস থেকে মিছরি, গুড়, চিন এমনকি ভিনেগার তৈরি হয়। কচি তালের ভেতরে এবং পাকা তালের আঁটির ভেতরের নরম শাঁস গ্রামে জনপ্রিয়। কচি শাঁসে প্রচুর ভিটামিন এ ও সি থাকে। তা ছাড়া পাকা তালের রস দিয়ে হরেক রকমের পিঠা, পায়েস, হালুয়া তৈরি হয়, যা খুবই সুস্বাদু, যোগ করেন এই অধ্যাপক।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তালগাছের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চন্দন রায়। তিনি বলেন, তালগাছ বাবুই পাখিসহ জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থল ও খাদ্যের অন্যতম উৎস। তালগাছ উজাড় হওয়ায় আশ্রয় হারিয়েছে বাবুই পাখি। অত্যধিক লম্বা ও পাতার অগ্রভাগ সুচালো হওয়ায় বজ্রপাত নিরোধক হিসেবেও তালগাছ উপকারী।

এ ছাড়া বায়ুপ্রবাহের গতিনিয়ন্ত্রণ, ভূমি ক্ষয় ও ভূমিধস রোধ এবং ভূগর্ভস্থ পানির মজুত বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ায় পরিবেশবান্ধব তালগাছ। তালগাছরে সারি সৌর্ন্দয্য বাড়ায় প্রকৃতির। বিশেষ কর্মসূচির বাইরেও বরেন্দ্র অঞ্চল ছাড়াও দেশজুড়ে ব্যাপক হারে তালগাছ রোপণের পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক।
 
‘বরেন্দ্র এলাকায় তালবীজ রোপণ কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের  দায়িত্বে ছিলেন বিএমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক হারে তালগাছ রোপণ করা হয়। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে এই কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত এই কর্মসূচির আওতায় রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জয়পুরহাট, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৮১টি উপজেলায় ১৬ লাখ তালবীজ রোপণ করা হয়েছে।
 
কর্মসূচির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রতিটি তালবীজ ১৬ টাকা হারে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার তালবীজ রোপণ করার কথা ছিল এই কর্মসূচিতে। কিন্তু বিএমডিএ রোপণ করেছে ২০ লাখ বীজ। এর মধ্যে কর্মসূচি শেষে চারা পাওয়া গেছে ১২ লাখ ৪ হাজার ৩৯টি। প্রতিটি তালবীজ ১৪ টাকা হিসাবে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৩৫ হাজার টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। কর্মসূচি বাস্তবায়নের পর উদ্বৃত্ত ৩০ লাখ টাকা ফেরত গেছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।

তিনি বলেন, তালগাছ রোপণের মাধ্যমে ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এবং বজ্রপাতে প্রাণহানি লাঘব ছিল এই কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য। এ ছাড়া কাঠের চাহিদা পূরণ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও প্রান্তিক জনসাধারণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির কথা মাথায় রেখে এই কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সফলভাবে তিনি কর্মসূচি শেষ করেছেন।


 
কর্মসূচি পরিচালক বলেন, তালবীজ রোপণে লটারির মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করে বিএমডিএর একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি। এ ছাড়া গাছ গণনা হয়েছে রিজিওনের তত্ত্বাবধানে। ভিন্ন উপজেলার কমিটি গণনা শেষে প্রতিবেদন দেওয়ার পর বিল পেয়েছেন ঠিকাদার। শর্ত ছিল, রোপণ করা চারার ৫০ শতাংশ গাছ না পেলে বিল পাবেন না ঠিকাদার। সেই হিসাবে ৮১ জন ঠিকাদারের মধ্যে বিল পাননি ১৩ জন। উল্টো এই ১৩ ঠিকাদারের রোপণ করা ১ লাখ ১২ হাজার ৮৪৮টি তালগাছ বিনামূল্যে পেয়েছে বিএমডিএ।
 
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ বলনে, মূলত তাল বীজের অঙ্কুরোদগম বিলম্বে হয়। দীর্ঘদিন পরও এর চারা গজাতে পারে। কিন্তু আমাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময়সীমা বাঁধা থাকায় আমরা দ্রুত গণনা শেষ করেছি। সরেজমিনে যতগুলো গাছ পাওয়া গেছে, কেবল তার বিপরীতে বিল পেয়েছেন ঠিকাদার। যাদের ১০ হাজারের নিচে গাছ পাওয়া গেছে, তারা বিল পাননি। সেই হিসাবে কর্মসূচি শেষে প্রায় ৩০ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যায়। নিয়ম মেনে সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন কর্মসূচি বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তা।
 
তিনি বলেন, বিশেষ করে তালগাছ লাগানোর পর তেমন পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না।  অনেকটা অনাদরেই বেড়ে ওঠে তালগাছ। তা ছাড়া বিশেষ এই র্কমসূচিতে তালগাছ পরিচর্যা খাতে বরাদ্দ ছিল না। দীর্ঘদিন ধরেই বরেন্দ্র অঞ্চলে তালগাছ রোপণ করে আসছে বিএমডিএ। এখনো বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতায় রোপিত হচ্ছে। এই অঞ্চলের মানুষ একসময় ব্যাপক হারে এই তালগাছের সুফল পাবে।

এনএ