অভিযুক্ত সৈকত মণ্ডল

রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লিতে হামলার অন্যতম হোতা হিসেবে গ্রেফতার হওয়া সৈকত মণ্ডল তথ্য গোপন করে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, নিজের ছাত্রত্বের পরিচয়ও গোপন রেখেছিলেন সদ্য বহিষ্কৃত এই নেতা। পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবেও সরকারি খাতায় রয়েছে তার নাম। পরিবারের দাবি- জন্ম থেকে সৈকতের হাত ও পায়ের আঙুলে সমস্যা রয়েছে।

পীরগঞ্জের রামনাথপুরের ইউনিয়নের চেরাগপুর গ্রামের বাসিন্দা সৈকত মণ্ডল। তার বাবা রাশেদুল হক মণ্ডল ও মা আঞ্জুয়ারা বেগম। গত ১৭ অক্টোবর রাতে চেরাগপুরের নিকটবর্তী হিন্দু অধ্যুষিত মাঝিপাড়াতে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার একদিন পর দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের কমিটির সহসভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় সৈকত মণ্ডলকে। ঘটনার পর সৈকত মণ্ডল তার সহযোগীকে নিয়ে আত্মগোপনে ছিলেন।

হামলার ঘটনার অন্যতম হোতা হিসেবে সৈকত মণ্ডল ও মসজিদের ইমাম রবিউল ইসলামকে গত ২২ অক্টোবর গাজীপুরের টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। এর পরদিনই ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটের ঘটনাটি ঘটানো হয়। এ ঘটনার অন্যতম হোতা কলেজছাত্র সৈকত মণ্ডল। ফেসবুকে উসকানি দিয়ে ও গুজব ছড়িয়ে হামলায় মদদ দেওয়া সৈকত মণ্ডলকে সহযোগিতা করেন একই ইউনিয়নের বটেরহাট মসজিদের ইমাম রবিউল ইসলাম।

র‍্যাব সৈকতের তেমন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় রংপুরের একটি কলেজের ছাত্র বলে তথ্য দেয়। সেদিন খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের জানান, সৈকত মণ্ডল রংপুরের একটি কলেজের শিক্ষার্থী। রংপুরে নিজেকে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

ওই সংবাদ সম্মেলনের পরই গণমাধ্যমকর্মীরা সৈকতের রাজনৈতিক পরিচয় বের করেন। সৈকত মণ্ডল কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দর্শন বিভাগের সহসভাপতি পদে ছিলেন। সহিংসতার ঘটনার পরদিনই তাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে র‍্যাবের সংবাদ সম্মেলনের পরই হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা সৈকত মণ্ডলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এর ঠিক ছয়দিন পর ২৪ অক্টোবর জরুরি সভা করে কারমাইকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা দেয় রংপুর মহানগর ছাত্রলীগ। এতে কারণ হিসেবে বলা হয় কলেজ কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে।

এদিকে মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মো. শফিউর রহমান স্বাধীন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে হামলার ঘটনায় গ্রেফতার সৈকত মণ্ডলকে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, সৈকত মণ্ডল রংপুর সরকারি কলেজের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থী হলেও ছাত্রত্বের পরিচয় গোপন রেখে কারমাইকেল কলেজ শাখার আওতাভুক্ত দর্শন বিভাগের কমিটিতে সহসভাপতি পদে কৌশলে অনুপ্রবেশ করেন।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, তথ্য গোপন করে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সৈকত মণ্ডলকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বিভিন্ন রকম বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে সংগঠনে অনুপ্রবেশ করে ষড়যন্ত্র করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। এমতাবস্থায় অনুপ্রবেশকারী অপরাধীর দায় সংগঠনের হতে পারে না। এ বিষয়ে কাউকে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য অনুরোধ করে সংগঠনটির নেতারা। 

অন্যদিকে সৈকতের গ্রামের বাড়ি পীরগঞ্জের চেরাগপুর এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তার বাবা রাশেদুল হক মণ্ডল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত নন। তবে তার দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল ও চাচা রেজাউল করিমসহ পরিবারের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর সৈকত মণ্ডল নিজেকে ছাত্রলীগ নেতা দাবি করলেও তার কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন ছিল বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। একই সঙ্গে হামলার ঘটনার পর সৈকতের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মানুষের মনে। যদিও তার পরিবার বলছে, প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি তালিকায় সৈকত মণ্ডলের নাম রয়েছে।  

এ ব্যাপারে সৈকতের মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, ঘটনার দিন ইউপি চেয়ারম্যান ছাদেকুল ইসলাম সাদেকের সঙ্গে আমার ছেলে ছিল। কিন্তু পরে শুনি ছেলেকে প্রশাসনের লোকজন খুঁজতেছে। বিষয়টা চেয়ারম্যানকে ফোনে জানালেতিনি আমাদেরকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে থাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু এখন চেয়ারম্যান তো কোনো কিছুই স্বীকার করছেন না।

তিনি আরও বলেন, আমার ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। জন্ম থেকে হাতে ও পায়ের আঙুলে সমস্যা। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। ছয় বছর আগে ২০১৫ সালের ২৬ আগস্ট রংপুর সমাজসেবা অধিদফতর থেকে একটা প্রতিবন্ধী কার্ড ইস্যু করেছি। পরের বছরের ২৩ মার্চ ইস্যু করা সেই পরিচয়পত্রটি (নিবন্ধন নম্বর ৪৮৫৭) হাতে পেয়েছি। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। ছেলে রংপুরে থাকলে ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিল করে। সেই ছেলেকে এখন শিবির অপবাদ দেওয়া হচ্ছে।

সৈকতের দাদা আবুল হোসেন মণ্ডল বলেন, আমরা নয়া আওয়ামী লীগ করি না। এখন তো অনেক হাইব্রিড নেতা। আমি বহু পুরাতন মানুষ। সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। যখন এলাকায় কেউ আওয়ামী লীগ করার সাহস পায় নাই, তখন থেকেই আওয়ামী লীগ করছি। নৌকা ছাড়া কিছু বুঝি না। আমার নাতিও ছাত্রলীগ করে। এই হামলা ও আগুন দেয়ার মতো জঘন্য কাম কি হামার ঘরের ছাওয়া করবার পারে? এটা নতুন ষড়যন্ত্র, তদন্ত করা দরকার।

রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ছাদেকুল ইসলাম সাদেক বলেন, সেদিন কী ঘটেছিল সেটা সবাই জানে। এলাকার জনপ্রতিনিধি আমি, অনেকেই আমার কাছে আসে। আমি সৈকতের ব্যাপারে কোনো কথা বলব না। এলাকায় যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা নিন্দনীয় ও ন্যাক্কারজনক। যারা হামলার সঙ্গে যারা জড়িত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে বিচারের আওতায় আনতে কাজ করছে।

উল্লেখ্য, গত ১৭ অক্টোবর রাতে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড়করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে উগ্রবাদীরা। এ ঘটনায় গ্রামটির ১৫টি পরিবারের ২১টি বাড়ির সব কিছু আগুনে পুড়ে যায়। সব মিলিয়ে অন্তত ৫০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। হামলাকারীরা গরু-ছাগল, অলংকার, নগদ টাকাও নিয়ে যায় বলে দাবি ক্ষতিগ্রস্তদের। এ ঘটনায় পুলিশ ও র‍্যাবের দায়ের করা চারটি মামলায় সোমবার (২৫ অক্টোবর) রাত পর্যন্ত ৬৯ জন গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রথম দফায় ৩৭ জনকে তিন দিনের রিমান্ডে পায় পুলিশ। বর্তমানে আরও ১৩ জন আসামির রিমান্ড চলছে।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর