শুঁটকি মৌসুম শুরু, হাজারো জেলের ৫ মাসের সমুদ্রযাত্রা
শীত শুরু হতেই সুন্দরবন উপকূলীয় ও বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা দুবলার চরে শুঁটকি আহরণ মৌসুম শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) সকাল থেকেই সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে জেলেরা সাগরে যাত্রা শুরু করেছেন। প্রতিবছর এই শুঁটকি মৌসুমে প্রায় ১৫ হাজার জেলে সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে অবস্থান নেন।
জানা যায়, পাঁচ মাস ধরে চলে সমুদ্রে মৎস্য আহরণ ও চরগুলোতে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রম। এ বছর বন বিভাগ প্রায় তিন কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এই শুঁটকিশিল্প থেকে।
বিজ্ঞাপন
বাগেরহাট, মোংলা, রামপাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশালসহ সুন্দরবন উপকূলের হাজার হাজার জেলে এখানে অবস্থান নেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, রংপুর অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবীরাও আসেন দুবলার চরে।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবারের শুঁটকি মৌসুমে দুবলার চরে জেলেদের জন্য ৯৮৫টি ঘর ও ৬৬টি ডিপোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শুঁটকি মৌসুম উপলক্ষে সুন্দরবনের দুবলার চরাঞ্চলে অন্তত ১২ থেকে ১৩ হাজার জেলে-ব্যবসায়ী ও শ্রমিকের সমাগম ঘটবে। তবে বনের কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয়, সে জন্য শুঁটকি আহরণে নিয়োজিত শ্রমিকদের ঘর তৈরির ক্ষেত্রে নানা শর্ত দিয়েছে বন বিভাগ।
বিজ্ঞাপন
যেসব চর এলাকায় শুঁটকি প্রক্রিয়াজাত করা হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দুবলার চর, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝির কেল্লা, শেলার চর, নারকেলবাড়িয়া, ছোট আমবাড়িয়া, বড় আমবাড়িয়া, মানিকখালী, কবরখালী, চাপড়াখালীর চর, কোকিলমনি ও হলদিখালীর চর।
কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামের জেলে ইব্রাহীম, ইয়াকুব ও ফারুক বলেন, আমাদের এলাকার ২৫ থেকে ৩০টি পরিবারের সবাই সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করি। কেউ ইলিশ আহরণ করে, আবার কেউ শুঁটকি তৈরির জন্য পরিবার-পরিজন ছেড়ে পাঁচ মাস সাগরে থাকে। সাগরে মাছ ধরায় রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। তবে পাঁচ মাসে আমরা যে পরিমাণ মাছ আহরণ করি, সেই অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাই খুবই কম। পাঁচ মাসের আয় দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে।
শরণখোলার জেলে ইউনুস, শাহ আলম, কামরুলসহ একাধিক জেলে জানান, বছরের পাঁচ মাস সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করি। সেটা বিশেষ প্রক্রিয়ায় শুঁটকি বানিয়ে বিক্রি করে জীবন চালাই। তারপরও মাছ ধরতে গেলে বিভিন্ন সময় দুর্যোগের মুখে পড়তে হয়। চরগুলোতে জেলেদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।
রামপাল উপজেলার মোতাহার, শামীম হাসানসহ কয়েকজন জেলে বলেন, ছয় মাস ধরে অপেক্ষা করতে থাকি শুঁটকি মৌসুম শুরু হওয়ার। ১৫ দিন আগে থেকে আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ভোরেই পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সাগরে রওনা দিয়েছি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে সাগরে যাই।
মৎস্যজীবী সংগঠন দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আতঙ্ক নিয়েই উপকূলীয় অঞ্চলের মৌসুমি জেলেরা জাল-নৌকা ও মৎস্য আহরণের উপকরণ নিয়ে সাগরপাড়ের জেলেপল্লিতে ছুটে যান। জেলেরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ আহরণ করেন। সেদিকে লক্ষ রেখে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার পাশাপাশি সুপেয় পানি ও চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান জেলেদের এই নেতা।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি মৌসুমে জেলেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার থেকেই জেলেরা মাছ আহরণে সমুদ্রে যাত্রা শুরু করেছেন। তবে জেলেরা যাতে চরগুলোয় তাদের মাচা তৈরি ও ঘর নির্মাণে অবৈধভাবে সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটতে না পারেন, সে ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া জেলেদের সার্বিক সুবিধা দিতে বন বিভাগের কর্মীরা নিয়োজিত থাকবেন।
এনএ