‘মুহূর্তেই নদীর পানিতে আমাদের সবার বসতবাড়ি ডুবে যায়। আমি দুই সন্তান ও পরিবারের অন্যদের নিয়ে কোনো রকমে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাঁশঝাড়ে কোমরপানিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লোকজন ছোট্ট একটি নৌকা এনে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। না হলে সবাই ভেসে যেতাম। এখন আমাদের ঘর নেই, নেই কোনো খাবার। এমন কষ্টের চেয়ে মরে যাওয়াই উচিত ছিল।’

বুধবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের তিস্তার বামতীরের চর ইছলির আখের আলীর স্ত্রী আলেমা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে এভাবে কথাগুলো বলেন।

বাড়িতে ফিরে কিছুই পাইনি। তবে চালের একটি বস্তা উদ্ধার করেছিল এক প্রতিবেশী। সেটি দিয়েছেন তারা। কিন্তু ভেজা চাল কি আর ভাত রান্না করে খাওয়া যায়। তাই রোদে শুকানোর চেষ্টা করছি। যদিও এ চাল দিয়ে ভাত খাওয়া যাবে কি না, জানি না। তবে এ ছাড়া তো কিছুই নেই আর আমাদের। আলেমা খাতুন

তিস্তার বামতীরের চর ইছলি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এর সঙ্গেই লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চর রুদ্রশ্বর। লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের কাকিনা বাজার থেকে কখনো মোটরসাইকেলে, কখনো নৌকায়, কখনো পায়ে হেঁটে পৌঁছানো গেল চর ইছলি। প্রায় ছয় কিলোমিটার পথের পাকা বা ইট বিছানো রাস্তা কদিন আগেও ছিল চলার উপযোগী। তবে গত বুধবারের আকস্মিক বানের পানি লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব।

এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, বাঁধহীন তিস্তার বামতীর থেকে অসময়ে আসা প্রায় চার ফুট উচ্চতার ঢেউ তাণ্ডব চালিয়েছে। রাস্তাঘাট ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে মানুষ হয়েছে পুরোপুরি আশ্রয়হীন। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ঘরবাড়ির ভাঙা অংশ। কদিন ধরে শিশু-নারীসহ এসব পরিবারের লোকজন রাত কাটাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে। জ্বলছে না তাদের চুলা। কেউ খাবার নিয়ে এলে তাতেই মিটছে সবার ক্ষুধা। তারা বলছেন, নদীর পানির কারণে তারা এভাবে নিঃস্ব হবেন, চরম কষ্টে পড়বেন, তা কখনো ভাবেননি।

চর ইছলি ও রুদ্রেশ্বরের মাঝ-বরাবর যাওয়া বিধ্বস্ত ইট বিছানো রাস্তা ধরে যতই সামনে এগোনো যায়, ততই দৃশ্যমান হয় মানুষের ক্ষয়ক্ষতি। দুধারে মলিন সব মুখ দেখে বোঝা যায়, কতটা কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে তাদের।

চর ইছলির হানিফ, মানিক, মোক্তার ও হাসান— এই চার ভাইয়ের ঘর একই উঠানের চারপাশে। বাড়িতে ঢুকে দেখা যায়, সব কটি ঘরের মেঝে খাদের মতো গর্ত তৈরি হয়েছে। শুধু ঘরগুলো খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। উঠানে খোলা আকাশের নিচে খাটে ঘুমাচ্ছে হানিফের এক বছর বয়সী ছেলে জুনায়েদ।

মানিক বলেন, বাড়িঘরের বেড়া, বিছানাসহ বাড়ির সবকিছু ভেসে গেছে পানিতে। ড্রামে রাখা চাল, হাঁড়ি-পাতিলও চলে গেছে পানির তোড়ে। এখন অন্যের বাড়ি থেকে রান্না করে এনে খাবার খাচ্ছি।

প্রতিবেশী রুদ্রেশ্বরের তাহেরুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখন বলতে গেলে আর কিছুই নাই। বন্যায় খেতের ফসল, বাড়িতে রাখা ধান-চাল নগদ টাকাসহ সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমরা একটা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়েছি।

সেখান থেকে কিছুটা সামনে গিয়ে দেখা যায়, ইট বিছানো রাস্তার দুই পাশ পানির তোড়ে ভেঙে মাঝখান যেন পরিণত হয়েছে ছোট্ট একটি দ্বীপ। হাঁটুপানি পেরিয়ে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একেবারে খোলা আকাশের নিচে থাকা একটি চৌকির এক পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কিছু গৃহস্থালির সামগ্রী, আরেক পাশে ঘুমিয়ে আছে এক শিশু।

সেখানেই বসে কয়েকজন দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। সামান্য দূরে শুকাতে দেওয়া হয়েছে বন্যায় ভিজে যাওয়া সামান্য চাল, এপাশ-ওপাশ পড়ে আছে থালাবাটি। খালের পানিতে ডুবে আছে তছনছ ঘর। অনেক দূরে লক্ষ করা যায়, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া চালের টিন।

কথা বলে জানা যায়, আখের আলীসহ চার ভাইয়ের বাড়ি ছিল রাস্তার পাশে। পানির তোড়ে সব কটি ঘর শেষ হয়েছে। এখন পরিবারের কয়েকজন ওই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন, বিভিন্নজনের রান্না করা খাবার খাচ্ছেন।

কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের বাগেরহাটে গিয়ে দেখা যায়, বন্যার পানির তোড়ে কয়েকটি দোকানও ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে দোকানের মালামাল। তাদেরই একজন মোনায়েম বলেন, নদীর পানি বাড়ার খবরে বাড়ি রক্ষায় সেখানে যাই। বাড়ি তো রক্ষা করতে পারিনি। এদিকে উপার্জনের একমাত্র পথ দোকানটি শেষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে এসে তিস্তা যেখানে দেশের ভূখণ্ড ছুঁয়েছে, সেই লালমনিরহাটের পাটগ্রামের দহগ্রাম ইউনিয়নের তিস্তাপাড়ের বসতবাড়ি, রাস্তা, ফসলের ক্ষেত বন্যার তাণ্ডবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেমনি এর প্রায় ১০০ কিলোমিটার ভাটিতে সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়নও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে তিস্তার দুইপাড়ে থাকা রংপুরেরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, জেলার পাঁচটি উপজেলায় ৮৪ হাজার ৪৮৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান রোপণ করা হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলনও বাম্পার হয়েছিল। দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে আমন ধান ঘরে তোলা শুরু হতো। এরই মধ্যে বন্যায় ডুবে গেছে ২ হাজার ৯৫৫ হেক্টর জমির আমন ধান ক্ষেত। এ ছাড়া ভুট্টা ১৯২ হেক্টর, চিনা বাদাম ৫২ হেক্টর, সদ্য রোপণ করা আলু ৬৪ হেক্টর, মাষকলাই ৫ হেক্টর, মরিচ ৫ হেক্টর, পেঁয়াজ ১৬ হেক্টর ও ৯১ হেক্টর বিভিন্ন জাতের সবজি ক্ষেত বন্যায় ডুবে নষ্ট হয়েছে। সব মিলে গত বন্যায় ৩ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, বন্যার্তদের জন্য ৭০ মেট্রিক টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পানি কমে যাওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। এ ছাড়া যাদের ঘর একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাদের ডিসেম্বরের মধ্যে ঘর দেওয়া হবে।

এনএ