দেশের দ্রুততম মানব এখন নাসিম
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নাসিমের। তার বাবা হাঁস-মুরগির ব্যবসা করেন। তাদের সাত সদস্যের পরিবারে অভাব-অনটন সব সময় লেগেই থাকে। তবু দমে যায়নি নাসিম। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে করে দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড গড়েছে সে। অর্জন করেছে দেশসেরা হওয়ার খেতাব।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার সায়মা শাহজাহান একাডেমি থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী মো. নাসিম। সম্প্রতি নেত্রকোনা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন আয়োজিত শেখ রাসেল ৩৭তম জাতীয় জুনিয়র (বয়সভিত্তিক) অনূর্ধ্ব-১৭ অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নিয়ে দেশের দ্রুততম মানবের রেকর্ড অর্জন করেছে। একই সঙ্গে সে ২০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায়ও প্রথম স্থান দখল করে।
বিজ্ঞাপন
কেন্দুয়া উপজেলার মোজাফরপুর ইউনিয়নের গগডা উত্তরপাড়া গ্রামের বাবুল ইসলামের ছেলে মো. নাসিমের এমন সাফল্যে উৎফুল্ল তার পরিবার, শিক্ষক, সহপাঠী, এলাকাবাসীসহ স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনও।
নিজস্ব কোনো সহায়-সম্পত্তি না থাকায় নাসিমের বাবা বাবুল ইসলাম দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় চিরাং বাজারের একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন। এখানে থেকেই তিনি হাঁস-মুরগি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে নাসিমদের বাসায় গেলে কথা হয় তার বাবা বাবুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্ত্রী জুবেদা আক্তার, দুই ছেলে ও তিন মেয়ে নিয়ে আমার ৭ সদস্যের সংসার। জমিজমা বলতে কিছুই নাই। হাঁস-মুরগির ব্যবসা করে কোনো রকম সংসার চালাই। আমার সংসারে দারিদ্র্য লেগেই আছে।
তিনি বলেন, আমার মেজ সন্তান নাসিম ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি সে সব সময় খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। এ বছর নাসিম এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এর আগেই সে দেশের দ্রুততম মানব হয়ে রেকর্ড গড়েছে। এতে আমরা গর্বিত। অর্থের অভাবে আমি তাকে সহযোগিতা করতে পারিনি। সে নিজের চেষ্টায় এতদূর এগিয়েছে। সহযোগিতা করলে হয়তো সে দেশের বাইরে গিয়েও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারত।
নাসিমের মা জুবেদা আক্তার বলেন, আমাদের সংসারে অভাব নিত্য। নাসিমের বাবা ছাড়া কামাই-রোজগারের আর কেউ নাই। বড় ছেলে তার বাবার সঙ্গে হাঁস-মুরগি কেনাবেচা করে। একার আয়ে সংসার চালছে কোনো রকম। নাসিমসহ তিন মেয়েকেও লেখাপড়া করাতে হচ্ছে।
আমার নাসিম নিজেই এতদূর এগিয়েছে। তার কোনো ওস্তাদ (প্রশিক্ষক) ছিল না। ২০১৭ সাল থেকে শুরু করে নাসিম প্রথমে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হয়েছে। এ বছর সে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হয়ে দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড করেছে। এ পর্যন্ত সে ৬৫টি মেডেল অর্জন করেছে। এতে আমরা খুবই আনন্দিত। সে যেন ভবিষ্যতে দেশের জন্য খেতাব অর্জন করে বিশ্বসেরা হতে পারে, এ জন্য সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করি। জুবেদা আক্তার
ঢাকা পোস্টকে নাসিম বলে, নেত্রকোনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে আমি গত ২২ ও ২৩ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতা অংশ নিয়ে ১০০ মিটার (বালক) দ্রুততম মানব অ্যাথলেট হওয়ার রেকর্ড গড়তে সক্ষম হয়েছি। এতে আমার সময় লেগেছে ১১.০০ সেকেন্ড। এ ছাড়া ২০০ মিটারেও আমি প্রথম স্থান অর্জন করেছি। এতে সময় লেগেছে ২২.৪০ সেকেন্ড।
আমি নিয়মিতভাবে লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়াচর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। এর আগেও আমি মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৯তম শীতকালীন জাতীয় স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা-২০২০ অংশ নিয়ে ১০০ মিটার দৌড় ও লম্বা লাফে বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা খেলোয়াড় হওয়ার গৌরব অর্জন করেছি।
নাসিম আরও বলে, এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আমি বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও খেলাধুলায় সেরা হয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনতে চাই। এ জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
সায়মা শাহজাহান একাডেমির প্রধান শিক্ষক শহিদুল হক ভূইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও অদম্য নাসিম আজ আমাদের গর্ব। সে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরাও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করে যাচ্ছি এবং আরও করব। আশা করছি সে একদিন দেশের জন্যও গৌরব বয়ে আনবে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈন উদ্দিন বলেন, নাসিমের এ অর্জন নেত্রকোনা ক্রীড়া সংস্থা তথা সমগ্র জেলার সুনাম। তার সুস্বাস্থ্য ও সফলতা কামনা করি। তার উন্নতির জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রযোজনীয় সহযোগিতা অবশ্যই প্রদান করব।
এদিকে দেশের দ্রুততম মানব হওয়ার রেকর্ড অর্জন করে নিজ এলাকায় ফিরে আসার পরপরই গত রোববার (২৪ অক্টোবর) নেত্রকোনা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও জেলা প্রশাসক কাজি মো. আব্দুর রহমান তার নিজ কার্যালয়ে মো. নাসিমকে ফুল দিয়ে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
মো. আব্দুর রহমান বলেন, নেত্রকোনার কৃতী খেলোয়াড় মো. নাসিম জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশের জন্য গৌরব অর্জন করল। এ জন্য জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে নাসিমকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করা হয়েছে। আশা করি ভবিষ্যতে সে বিশ্বসেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করবে।
এনএ