শিক্ষাজীবনে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। আর কর্মজীবনে মানবিক চিকিৎসক। এই দুইয়ের সংমিশ্রণে তিনি হয়ে ওঠেন প্রকৃত মানুষ। কিডনি রোগীদের চিকিৎসায় নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সরকারি চাকরি করে যে অর্থ তিনি আয় করেছিলেন, সেই সঞ্চিত অর্থ দিয়ে তিনি বাড়ি-গাড়ি না করে কিডনি রোগীদের কথা ভেবে কিনেছিলেন ডায়ালাইসিস মেশিন।

যে মেশিনের কারণেই আজ অনেকে পেয়েছেন বিনা পয়সায় উন্নত কিডনি চিকিৎসাসেবা। এভাবেই পরিণত হয়েছেন দেশের মানুষের আস্থা ও ভরসাস্থলে। সরকারি হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন কিডনি হাসপাতাল।

এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন কার কথা বলা হচ্ছে। তিনি হলেন বিনা পারিশ্রমিকে সহস্রাধিক কিডনি প্রতিস্থাপনকারী জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা কিডনিবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কামরুল ইসলাম। তিনি পাবনার ঈশ্বরদীর কৃতী সন্তান। বিনা পারিশ্রমিকে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৭টি কিডনি প্রতিস্থাপন করে ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছেন তিনি। দরিদ্র মানুষের শুধু কিডনি প্রতিস্থাপনই করে দেননি তিনি, একইসঙ্গে কিডনির সক্রিয়তা নিশ্চিতকরণে বিনা পয়সায় মাসিক ফলোআপ করে আসছেন। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পিতার অনুপ্রেরণা আর মানবসেবায় ব্রত হয়েই চিকিৎসাসেবা বেছে নিয়েছিলেন কামরুল ইসলাম। তিনি আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সাবেক কর্মকর্তা ও ঈশ্বরদীর আমিনপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলাম আমিনের মেজো সন্তান। 

পারিবারিক তথ্যে জানা গেছে, স্বামীহারা এসএসসি পাস করা মা রহিমা খাতুন তার চার ছেলেকে মানুষ করার জন্য এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আবার পড়াশুনা শুরু করেন। এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সমাজবিজ্ঞানে ১ম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৮১ সালে রহিমা খাতুন ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে যোগদান করেন। মেজো ছেলে কামরুল ইসলাম ঈশ্বরদী উপজেলার চন্দ্র প্রভা বিদ্যাপীঠ পাকশী থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৩তম স্থান অর্জন করেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেখানেও দশম স্থান অধিকার করেন। ১৯৮২ সালে তখনকার ৮টি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ১ম স্থান অর্জন করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়ন শুরু করেন।

ঢাকা মেডিকেল থেকে ১৯৮৯ সালে পাস করে ইন্টার্নশিপ শেষ করেন ১৯৯০ সালে। পরবর্তীতে একাদশ বিসিএসে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি ঢাকা মেডিকেলে যোগদান করেন।

পরবর্তীতে তিনি ইউরোলজিতে ৫ বছর মেয়াদি এমএস প্রোগ্রাম সম্পন্ন করেন এবং জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে সফলভাবে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট শুরু করেন। সরকারি হাসপাতালের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শ্যামলীতে নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন কিডনি হাসপাতাল। 

অধ্যাপক কামরুল ইসলাম ২০১৪ সালে অসহায় রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে ঢাকার শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। করোনা মহামারির মধ্যে গণস্বাস্থ্য কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার ছাড়া যখন সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিসসহ কিডনি রোগীদের সেবা বন্ধ ছিল, তখনও সিকেডি হাসপাতাল তার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে গেছে।

বর্তমানে এই হাসপাতালে প্রতি সপ্তাহে ৪টি করে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। যা দেশের অন্য যেকোনো হাসপাতালের তুলনায় বেশি। ন্যূনতম নির্ধারিত খরচ বাদে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য বিশেষজ্ঞ সার্জনের কোনো ফি নেন না অধ্যাপক কামরুল ইসলাম। রোগীদের ফলোআপ পরীক্ষার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে পরীক্ষা-নীরিক্ষার খরচ ও রিপোর্ট দেখার খরচও নেন না তিনি। 

সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের অবস্থান ঢাকার শ্যামলীর ৩ নম্বর সড়কে। ছয়তলার একটি সাদামাটা ভবনে চলছে এই প্রতিষ্ঠানের মানবিক এই কার্যক্রম। এই হাসপাতালে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ মূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সেবায় ১৫ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আছে ২ জনের অস্ত্রোপচার খরচ (রোগী ও ডোনার), বেড ভাড়া ও ওষুধ খরচ।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর চেয়ে কম খরচে দেশের বেসরকারি কোনো হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। পাশের দেশ ভারতেও কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য খরচ হয় ১৫ লাখ টাকার বেশি। এছাড়া সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচও তুলনামূলক কম। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হলে সিকেডি হাসপাতালেই তার ব্যবস্থা আছে। আছে ২২ বেডের একটি ডায়ালাইসিস ইউনিট। খরচ দেড় হাজার টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।

অধ্যাপক কামরুল জানান, এই ফলোআপের কারণে রোগীর কিডনি অনেক দিন সুস্থ থাকে। যদি ফলোআপ পরীক্ষার জন্য টাকা নেওয়া হতো, তাহলে রোগীদের বড় একটি অংশ কিডনি প্রতিস্থাপনের পর ফলোআপ পরীক্ষা করতে আসতেন না। তাতে অনেকেরই কিডনি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকত।

তিনি জানান, কিডনি প্রতিস্থাপন করা রোগীর ভালো থাকার অন্যতম শর্ত এই ফলোআপ। প্রথমদিকে প্রতি মাসে ১ বার, পরবর্তীতে ২-৩ মাস পর পর এই ফলোআপের দরকার হয়। প্রতিদিন অনেক রোগী দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই হাসপাতালে ফলোআপের জন্য আসেন।

তিনি আফসোস করে বলেন, এসব রোগীদের বেশির ভাগই দরিদ্র শ্রেণির। দেখা যায় সারারাত জার্নি করে তারা ঢাকায় আসেন। সারাদিন হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সন্ধ্যায় ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি যান। মাঝের সময়টাতে তাদের একটু বিশ্রাম ও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে শান্তি পেতাম। কিডনি রোগীর জন্য সেটা খুব জরুরি।

কর্মজীবনের জমানো টাকায় গাড়ি না কেনেন ডায়ালাইসিস মেশিন। বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে গড়েন বিশেষায়িত হাসপাতাল। সেখানে পারিশ্রমিক ছাড়াই শুরু করেন কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট। চৌদ্দ বছরে সহস্রাধিক অপারেশনে সফলতার হার ৯৫ শতাংশ। বীর মুক্তিযোদ্ধা পিতার প্রতি সম্মান জানাতেই তার এই প্রচেষ্টা। শেষ নিশ্বাস অবধি রোগীদের নিরাশ করতে রাজি নন তিনি। 

অধ্যাপক কামরুল ইসলামের শিক্ষা জীবনের একজন শিক্ষকই বেঁচে আছেন। তিনি পাকশি চন্দ্র প্রভা উচ্চ বিদালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল কালাম আহাদ। তিনি বলেন, সে আমার ছাত্র হওয়ায় নিজে গর্ববোধ করি। স্কুলজীবনে প্রখর মেধার অধিকারী ছিল। খাতা দেখতে গিয়ে কোথাও লাল কালি দেওয়ার সুযোগ পাইনি। শিক্ষক হিসেবে জীবনের সেরা পাওয়া হলো আমার ছাত্র বিনা পারিশ্রমিকে হাজারো রোগীকে কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে।

গুণী এই চিকিৎসকের মা রহিমা খাতুন জানান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের অ্যাগ্রোনোমিস্ট আমার স্বামী আমিনুল ইসলাম আমিনকে ঈশ্বরদী রোডের ওয়াপদা গেটের কাছে একটি বাড়িতে ডেকে এনে রাজাকার-আলবদররা বেয়নেট ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। আমার ছোট ছেলের জন্মের তৃতীয় দিন এই ঘটনা ঘটে। আমি আমার স্বামীর লাশটিও দেখতে পারিনি। নানা প্রতিকূলতার মাঝেও নিরাশ না হয়ে সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে চেষ্টা চালিয়ে গেছি।

তিনি আরও জানান, আমার প্রথম সন্তান ওয়ালিউর রহমান মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে আমার মেজো ছেলে কামরুল ইসলাম আজ দেশের একজন গুণী চিকিৎসক হয়েছে। তৃতীয় সন্তান জাহিদুল ইসলাম প্রকৌশলী হলেও দূরারোগ্য ক্যান্সারে মারা যায়। চতুর্থ সন্তান রাজিউল ইসলাম। সেও প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে থাইল্যান্ডে বসবাস করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ঈশ্বরদীর আলোবাগ ক্লাবের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে আমার স্বামী শহীদ হওয়ায় তার নামানুসারে এলাকাবাসী শহীদ আমিনপাড়া নামকরণ করেছেন।

ঈশ্বরদী নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ কিরণ বলেন, কামরুল ইসলামের জন্য ঈশ্বরদীসহ পুরো পাবনাবাসী গর্বিত। ঈশ্বরদীর মানুষের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তিনি। তার কথা এখন প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে আলোচনা হচ্ছে।

পাবনা মেডিকেল কলেজের প্রধান সহকারী ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি নিজেও তার কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়েছি। যেখানে আমার অন্য জায়গায় ১ লাখ টাকা খরচ হতো এখানে হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। আমি তাকে একদম কাছ থেকে জানি। তিনি একজন মানবিক চিকিৎসক।

পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. কেএম আবু জাফর জানান, সরকারিভাবে তার কাজের স্বীকৃতি দিলে দেশের জন্য অনেক ভালো হবে। অন্য দেশে একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে গেলে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ হয়। আর কামরুল ইসলাম মাত্র ২ লাখ টাকায় সেটি সম্পন্ন করে থাকেন। তাকে যথাযথ সম্মান দেয়া উচিত।

এমএসআর