মরিয়মের বয়স তখন ছয় কি সাত। দুই বোনসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একদিন মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যায়। বিভিন্ন প্রাণী দেখতে দেখতে হঠাৎ হারিয়ে যায় সে। দিগবিদিক খোঁজাখুঁজির পর একসময় হারিয়ে ফেলে পরিবারকেও। তারপর বিভিন্ন হাতবদল হয়ে মরিয়ম ঠাঁই হয় এক দম্পতির বাড়িতে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। এরই মধ্যে কেটে যায় অন্তত ১১টি বছর।

অবশেষে স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডের ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেই মরিয়ম খুঁজে পেয়েছে তার হারানো পরিবারকে। আর হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও হাহাকার পূর্ণতা লাভ করেছে মা বেগমের।

মরিয়মের ফিরে আসায় পরিবারটিতে এখন বইছে আনন্দের বন্যা। তাকে সবাই বুকে জড়িয়ে ধরে হালকা করছেন দীর্ঘদিনের পুষে রাখা কষ্টের বোঝা। আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীরাও তাকে দেখতে ভিড় করছেন তার বাড়িতে।

আরও পড়ুন : ৪০ বছর পর মিনতি ফিরে পেলেন আপন ঠিকানা

মরিয়ম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভবানীপুর ইউনিয়নের কান্দানিয়া গ্রামের মৃত আমছর আলী ও মোছা. বেগম দম্পতির মেয়ে।

জানা গেছে, মরিয়ম ছোট থাকতেই তার বাবা মারা যান। অভাবের সংসারে খরচ জোগাতে দুই বোন লাইলি ও সুফলা চাকরি করতেন গাজীপুরের একটি পোশাক কারখানায়। ২০১০ সালে একদিন সেই বোনদের সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলেন মরিয়মসহ পরিবারের লোকজন। পরদিন সবাই মিলে বেড়াতে যান মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায়। সেখানে প্রাণীদের ঘুরে দেখতে দেখতে একসময় দলছুট হয়ে পড়েন মরিয়ম। বোনদের খুঁজতে খুঁজতে তিনি বেরিয়ে পড়েন মূল গেটের বাইরে। অন্যদিকে পরিবারও হন্যে হয়ে খুঁজে আর পায়নি মরিয়মকে।

এদিকে মরিয়মের পাশে অনেকে দাঁড়ালেও হাতবদল হয়ে মরিয়ম সবশেষ আশ্রয় পান এক মানবিক দম্পতির হাতে। সরকারি চাকরিজীবী মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ ও রাবেয়া আহমেদ দম্পতির কাছেই দীর্ঘ ১১ বছর তাদের মেয়ের মতোই আদর-যত্নে বেড়ে ওঠা শুরু করেন। মরিয়মও একসময় তাদের আপন করে নেন। তারাই এখন মা ও বাবা। তবু মাঝেমধ্যে মনে পড়ত মা-বোনদের কথা। যদিও মরিয়ম ওই বয়সটুকুতে কখনো চিন্তা করেননি আবারও ফিরতে পারবেন মায়ের কোল। তবু বড় হতে হতে স্বপ্ন দেখতেন, একদিন ঠিকই ফিরে পাবেন মাকে।

জনপ্রিয় উপস্থাপক আরজে গোলাম কিবরিয়া সরকারের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘আপন ঠিকানা’ তার সন্ধান পায়। গত ২৬ অক্টোবর রাত ৮টা ১৯ মিনিটে আরজে কিবরিয়া পেজে প্রচারিত হয় মরিয়মের একটি সাক্ষাৎকার। সেটি পোস্ট হয় পেজে। চার ঘণ্টা অতিবাহিত হতেই এবার মরিয়মের পরিবারেরও সন্ধান পেয়ে যায় আপন ঠিকানা টিম। রাত ১২টা ৫৮ মিনিট। আবারও পোস্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয় পেজ থেকে। রোববার (৩১ অক্টোবর) আপডেট ভিডিওতে নিশ্চিত করা হয়, আপন ঠিকানার ৮৫তম পর্বের সফলতা। এদিন রাতেই মা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন মরিয়ম।

আরও পড়ুন : ‘‌আপন ঠিকানা’র মাধ্যমে ২২ বছর পর বাবা-মাকে ফিরে পেলেন তানজিমা

পরিবারের খুশির সেই মাহেন্দ্রক্ষণ দেখতে সোমবার (১ নভেম্বর) সকালে কান্দানিয়া এলাকায় মরিয়মের গ্রামের বাড়িতে যায় ঢাকা পোস্ট। সকালের খাওয়াদাওয়া শেষে বাড়ির উঠানে বসে আছেন মরিয়ম। তাকে ঘিরে বসে আছেন বাড়ির লোকজনসহ আশপাশের উৎসুক মানুষজন। মরিয়মকে দেখার জন্য পাড়াপ্রতিবেশী ও নারী-শিশুরা ছুটে আসছে বাড়িতে। মরিয়মও কথা বলে চলেছেন সবার সঙ্গে, যেন কতদিনের চেনা এই মুখগুলো।

ঢাকা পোস্ট জানতে চায় মরিয়মের মনের অব্যক্ত কথাগুলো। তিনি বলেন, হারিয়ে যাওয়ার পর আমি কয়েকজনের কাছে থেকেছি। তবে শেষে বর্তমান খালাম্মা-খালুর বাড়িতে ১১ বছর ধরে আছি। খালাম্মা ফেসবুকে ‘আপন ঠিকানা’ অনুষ্ঠানটা দেখতেন। সে জন্য আমার মনে থাকা কথাগুলো তিনি লিখে রেখেছেন এবং তিনিই আমাকে এই অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছেন।

মরিয়ম আরও বলেন, ভিডিও করার পরও কখনো ভাবি নাই যে আমার পরিবারকে পাব এবং মায়ের কাছে ফিরতে পারব। এখন ফিরতে পেরে আমার কাছে কেমন ভালো লাগছে, তা বলে বোঝাতে পারব না।

আরও পড়ুন : ২৫ বছর পর আপন ঠিকানায় ফিরলেন আঁখিনুর

মরিয়মের বোন সুফলা আক্তার বলেন, ফেসবুকও দেহার পরে আমরা তো চিনছিই। পরে ঢাহাত গিয়া দেহা করছি। আমার গলাত যে দাগ আছে, এইডা মরিয়মের মনো আছিন। এই দাগটা দেইখ্যাই আমারে চিইন্ন্যা হালছে। বহুত বছর পরে বইন রে ফিররা পাইয়া আঙ্গর এহন অনেক ভালা লাগতাছে।

মৃত্যুর আগে হলেও হারানো মেয়েকে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন মা বেগম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হারানো মেয়েকে ফিরে পেতে অনেক মানুষের কাছে গিয়েছি, তাদের পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছি কিন্তু মেয়েকে পাইনি। অনেক কান্নাকাটি করেছি আর আল্লাহকে বলেছি, মেয়েকে না দেখিয়ে আমার মৃত্যু দিও না। কয়েক দিন আগে ফেসবুকে ভিডিও ছাড়ার পরে আল্লাহর রহমতে আমরা তাকে ফিরে পেয়েছি। আমার মরিয়ম এখন আমার বুকে।

এনএ